নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া নাসিক নির্বাচন ঘিরে একের পর এক কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ায় নেতাকর্মীদের হৃদয়ে শুরু হয়েছে রক্তক্ষরণ। নাসিক নির্বাচনের ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে গোছানো সংগঠনের মজবুত ভীত। এমন পরিস্থিতি কখনো দেখেনি দলের প্রবীন নেতারাও। অন্যদিকে বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী ৯দিনের মধ্যে ৩টি কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ায় অন্য কমিটিগুলোর নেতাদের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভেঙ্গে দেওয়া কমিটিগুলোর নেতারা রীতিমত বিব্রত হয়েছেন। নির্বাচন চলাকালীন সময়তো বটেই, নির্বাচনে ভোট গ্রহণ এবং এর পরদিনও দু’টি কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে।
তবে কমিটি বিলুপ্ত করা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মত আছে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে। কেউ বলছেন সবগুলো কমিটিই মেয়াদোর্ত্তীণ। ফলে কমিটিগুলো বিলুপ্ত করাটাই স্বাভাবিক। আবার কারও কারও মতে কমিটিগুলোকে ব্যক্তি বলয় থেকে বের করে আনার জন্যই এই ব্যবস্থা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রচারণা চলাকালীন গত ৯ জানুয়ারি প্রথম বিলুপ্ত করা হয় নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্র লীগের কমিটি। এর ৮ দিনের মাথায় ১৬ জানুয়ারি সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন বিলুপ্ত করা হয় স্বেচ্ছসেবক লীগের জেলা ও মহানগর কমিটিসহ সব ইউনিট। পরদিন বিলুপ্ত করা হয় মহানগর শ্রমিক লীগের কমিটি। আরও অনেক কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হবে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ স্পষ্ট ভাবে নগরের উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত। উত্তরের নেতৃত্বে রয়েছেন এই নগরের ঐতিহ্যবাহি ওসমান পরিবার। আর দক্ষিণের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে সিটি করপোরেশনের টানা ৩ বারের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কেন্দ্র করে। তবে রাজনৈতিক ভাবে ওসমান বলয়েই বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের অবস্থান। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনগুলোতে তাই ওসমানপন্থি নেতার আধিক্য দেখা যায়। ওসমান পরিবার থেকে জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি রাজনীতিবিদও গড়ে উঠেছে। একেএম শামসুজ্জোহার পর তার ৩ ছেলেই নারায়ণগঞ্জে সংসদ সদস্য হয়েছেন এবং দু’জন বর্তমানেও সংসদ সদস্য।
পক্ষান্তরে আইভীকে কেন্দ্র করে অপর একটি বলয় গড়ে উঠলেও এই বলয়ের নেতারা একক নেতা হিসেবে পরিচিত। অর্থ্যাৎ ‘ওয়ান ম্যান শো’-টাইপের। ২০০৩ সালে সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার শেষ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নগরের দক্ষিণাঞ্চলের নেতারা তাকে ঘিরে একটি বলয় তৈরী করেন। সেই বলয় একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সারাহ বেগম কবরী নির্বাচিত হওয়ার পর। কবরী ও আইভী একজোট হয়ে একটি শক্ত বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে শামীম ওসমান তার হারানো আসন ফিরে পাওয়ায় সেই বলয় একটি নির্দিষ্ট অবস্থানেই থমকে যায়। তাছাড়া আইভী বলয়ের নেতারা প্রকৃত অর্থে সেভাবে নারায়ণগঞ্জে রাজনীতি করেন না। তাদের ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো অবস্থা।
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাংগঠনিক ভাবে শামীম ওসমান বলয় বেশ শক্তিশালী। সংগঠন চালাতে দক্ষ শামীম ওসমান। তিনি তার দক্ষতা দেখিয়েই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠন গুলোতে তার অনুসারিদের পদায়ন করেছেন। ফলে কয়েক ঘন্টার নোটিশে হাজার নেতাকর্মীর সমাগম ঘটাতে তাকে বেগ পেতে হয় না। যাকে বলে ‘হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা’।
পক্ষান্তরে আইভী শিবিরে যেসব নেতা রয়েছেন তারা বিভিন্ন সময় ওসমানদের সঙ্গে গা ভাসিয়ে রাজনীতি করেছেন। দলের জন্য তারা নেতা বা কর্মী কোনটাই তৈরী করতে পারেননি। আইভীপন্থি নেতারা দলের জেলা ও মহানগরসহ সহযোগি অনেক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকলেও তারা ভবিষ্যত নেতা বা কর্মী কোনটাই তৈরী করতে পারেননি। বলতে গেলে তারা একা একাই রাজনীতি করেছেন।
এদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার অভিযোগে ইতিমধ্যেই মহানগর ছাত্র লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা ও মহানগর কমিটি এবং শ্রমিক লীগের মহানগর কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। কেউ কেউ বলছেন ব্যক্তি বন্দনার কবল থেকে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগকে বের করে আনতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনের একাধিক নেতা বলেন, যাদের বিষয়ে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হচ্ছে তারা সবাই দলের পরীক্ষিত নেতা। এসব নেতাদের অনেকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর দায়ের করা অথবা তার পক্ষে দায়ের করা মামলার আসামী। এসব মামলা আদালতে চলমান, অথবা তদন্তাধীন। এটা এই নগরের মানুষ জানে। আসামী হয়ে বাদির সঙ্গে প্রচারণায় নামলে এতে প্রার্থীরই ক্ষতি হতে পারে ভেবে অনেক সংগঠনের নেতারা নিরবে নিভৃতে প্রচারণা করেছেন। তাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। যেহেতু এটা দলীয় প্রতীকের নির্বাচন। কিন্তু মিডিয়া কভারেজ না পাওয়ায় এবং নিরবে কাজ করায় অনেকেই বিষয়টিকে নেতিবাচক ভাবে দেখেছেন। যার ফলে অবিশ^াস তৈরী হয়েছে। সেই অবিশ্বাস থেকে কেন্দ্রীয় নেতা যারা নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন পরিচালনা বা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন তাদের কাছে ভুল ম্যাসেজ গেছে।
একের পর এক কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া এবং আরও কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়ার গুঞ্জনকে কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, আপনি আওয়ামী লীগ করেন, কিন্তু দলের চেয়ে ব্যক্তির প্রতি আপনার আনুগত্য বেশি। ব্যক্তি পূজা ছাড়া আপনি কিছুই করেন না। দল প্রার্থী দিয়েছে তার পক্ষে আপনি কাজ করেননি। দলের প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের প্রার্থী ঘোষণা করেই বলেছেন, আমি প্রার্থী দিয়েছি। সব দুঃখ কষ্ট ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে হবে। অনেক নেতা আছেন যারা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ৫ মিনিট থেকে ফটোসেশন করে চলে গেছেন। এরপর আর কোন খবর ছিল না। এসব বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতাদের নজরে এসেছে। তাই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানোর জন্যই কমিটি গুলো বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে বা হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজাম বলেন, সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতারা সবকিছু দেখভাল করেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন স্থানীয় নেতারা সঠিক ভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাই কমিটি ভেঙ্গে দিয়েছেন। সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি চান কিনা জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, আমাদের তৃণমূলে সব চাওয়া কি পূরণ হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যেভাবে চাইবেন বা আমাদের দলের নেত্রী যাদের উপর দায়িত্ব দেবেন তারা যেভাবে করবে সেভাবেই হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, নারায়ণগঞ্জের সব কমিটিই মেয়াদোর্ত্তীণ। কেন্দ্র মনে করলে কমিটি ভেঙ্গে দিতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ কেন্দ্রের ব্যাপার।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ কেন্দ্র থেকেই একপেশে কমিটি করে দেওয়া হতো। এরজন্য কেন্দ্রই দায়ি। এভাবে একপেশে কমিটি করে দেওয়ার কারণেই সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে কী হয়েছে তা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ খুব কাছ থেকে দেখে গেছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রের উচিত হবে সহযোগি সংগঠনের সবগুলো কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে সেগুলো পুনর্গঠন করা। তাছাড়া অনেক কমিটি রয়েছে যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মোঃ শহীদ বাদল বলেন, একের পর এক কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার নিশ্চই কোন না কোন কারণ রয়েছে। তবে এতে দলের কোন ক্ষতি হবে না। দল দলের নিয়ম কানুনের মধ্যেই চলে। তবে আমি বিশ^াস করি আগামীতে যেভাবেই কমিটি হোক না কেন দলে ত্যাগি নেতাদেরই মূল্যায়ন হবে। সেই সঙ্গে একই ব্যক্তিকে বার বার একই পদে না রেখে নতুনদের সুযোগ তৈরী করে দিয়ে আগামী দিনের জন্য নেতৃত্ব তৈরী করতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারেন, তবে নেতারা অবশ্যই সবকিছু যাচাই বাছাই করে দেখেই সিদ্ধান্ত নেবেন