ইসলামি শরিয়তের মূল বিধান হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে যত জিনিসই সৃষ্টি করেছেন, তা সবই হালাল ও মুবাহ।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.) যা অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে ‘হারাম’ বলে চিহ্নিত করেছেন, কেবল তা-ই হারাম। এর বাইরে কোনো কিছুই হারাম হতে পারে না।
নতুন কোনো বিষয়ে যদি হারাম হওয়ার অকাট্য দলিল না থাকে, কিংবা দলিলের সঙ্গে যদি ওই বিষয়টার স্পষ্ট সম্পর্ক না থাকে, তাহলে সেটি জায়েজ ও মুবাহ হবে। কোনো মনগড়া দলিল তাকে হারাম বানাতে পারে না।
কারণ আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, এই পৃথিবীতে যা আছে সবই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৯)
আল্লাহ যেহেতু সবই আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাই মৌলিকভাবে সবই হালাল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেসব জিনিস হারাম ঘোষণা করেছেন—যেমন মদ, শুকর, সুদি লেনদেন বা জুলুম করা—এসব আলাদা হবে।
কিন্তু আল্লাহ হারাম করেননি এমন কোনো প্রাণী, যেমন গরু ও মুরগি, কেউ চাইলেও তা হারাম করতে পারবে না। আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেন, তোমাদের কী হলো, যেই পশু আল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে তা খাচ্ছো না? তোমাদের জন্য কোনটা হারাম আল্লাহ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সেই হারামও হালাল হয়ে যাবে যদি তোমরা নিরূপায় হও। (সুরা আনআম, আয়াত ১১৯)
মুশরিকরা বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন জিনিশকে হারাম বানিয়ে নিয়েছিল, আল্লাহ তাআলা তাই সতর্ক করে বলেন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ্ তোমাদের রিজিক যে দিয়েছেন, তার মধ্যে হালাল-হারাম তোমরা নির্ধারিত করে নিয়েছে? বল, আল্লাহ কি তোমাদের তা করার অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহ্র নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছ? (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৯)
আল্লাহ আরও বলেন, তোমাদের মুখে যা আসে তা-ই বলে দিও না—এটা হালাল ও এটা হারাম। এতে আল্লাহর নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা চালানো হবে। আর যারাই আল্লাহ্র নামে এ ধরনের মিথ্যা প্রচার করে, তারা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না। (সুরা নহল, আয়াত ১১৬)
একবার কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজের জন্য মধু খাওয়া হারাম বানিয়ে নিয়েছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তখন আয়াত নাজিল করে বলেন, হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন আপনি তা হারাম করছেন কেন? (সুরা তাহরিম, আয়াত ১)
হালাল ও হারাম বিষয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তার কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল। যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে বিষয়ে তিনি নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তাতে ক্ষমা রয়েছে। অতএব তোমরা আল্লাহ্র কাছ থেকে তার ক্ষমা গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ তো কোন কিছু ভুলে যান না। (এ কথার প্রমাণ হিসেবে তিনি কোরআনের এই আয়াত বলেন) وَمَا كَانَ رَبُّك نَسِيَّا —তোমাদের প্রভু ভুলে যান না। (সূত্র : দারা কুতনি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৭/ মুস্তাদরাকে হাকেম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৬/ তাবরানি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৯)
আল্লাহর রাসুলকে (সা.) চর্বি, মাখন, পনির ও কোমল পশু লোমের তৈরি পোশাক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ্ তার কিতাবে যা হালাল ঘোষণা করেছেন, তা হালাল। যা হারাম ঘোষণা করেছেন, তা হারাম। আর যে বিষয়ে তিনি নীরবতা অবলম্বন করেছেন তা ‘মাফ করা দেওয়া হয়েছে’ জিনিশের মধ্যে গণ্য হবে।
(সূত্র : সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ১৭২৬/ ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৩৬৭/ মুস্তাদরাকে হাকেম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১২৯/ বায়হাকি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩২০/ তাবরানি, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫০)
খেয়াল করে দেখুন, প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহর রাসুল (সা.) একটা একটা করে কোনটা হালাল কোনটা হারাম বলেননি, বরং সামগ্রিক নীতি বলে দিয়েছেন।
আরেক জায়গায় তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা কতগুলো কাজকে ফরজ করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা তা নষ্ট করে ফেল না। তিনি কতগুলো বিষয়ে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তোমরা তার সীমালংঘন করো না। কিছু কিছু জিনিসকে তিনি হারাম করেছেন, তোমরা তার বিরোধিতা করো না। আর তোমাদের প্রতি অনুগ্রহবশত—ভুলে না গিয়ে—অনেক বিষয়ে তিনি পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। অতএব সে বিষয়ে তোমরা বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। (সূত্র: দারা কুতনি, হাদিস নং ৪৩৯৬)
তবে এখানে বলে রাখতে হয়, কিছু কিছু বিষয় আল্লাহর রাসুলও (সা.) হারাম করেছেন, যেমন গৃহপালিত গাধার মাংস খাওয়া। হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, শুনে রাখ, অচিরেই এমন লোকের আমদানি হবে যে তার সুসজ্জিত আসনে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে; তখন তার কাছে আমার কোনো হাদিস পৌঁছালে সে বলে উঠবে, আমাদের মাঝে এবং তোমাদের মাঝে তো আল্লাহর কিতাবই আছে। এতে আমরা যা হালাল হিসেবে পাব তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করব আর যা হারাম হিসেবে পাব তা হারাম মনে করব। অথচ আল্লাহর রাসুল যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতই হারাম।
(সুত্র: তিরমিজি, হাদিস নং ২৬৬৪/ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১২/ সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬০৪/ সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ১২)
উপসংহারে আমরা বলতে পারি কোনো কিছু হালাল বা হারাম নির্ধারণ করা একমাত্র আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের (সা.) এখতিয়ারে আছে, কোনো বান্দার কাছে নাই। আজকাল অনেকে অনুমান ও সন্দেহবশত বিভিন্ন হালাল জিনিসকে হারাম বলছেন, অথচ ইসলাম অযথা সন্দেহ করতে নিষেধ করে।
কুরআনে আছে, নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান গুনাহের কারণ। (সুরা হুজরাত, আয়াত ১২)
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে তা-ই বলে। (আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৯৯২)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সংশয় ও সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।