২০১৫ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে দারুণ পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ঘরের মাঠে অব্যাহত ছিল বাংলাদেশের। মাশরাফির ক্ষুরধার নেতৃত্বে জেতা হয়েছে টানা ৫টি সিরিজ। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে নেমেই ছন্দপতন হয় তাদের। ২০১৬ সালে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ তারা ২-১ ব্যবধানে হেরেছে। ৭ বছর পর পুনরাবৃত্তি হলো একই পরিস্থিতির। ইংলিশদের বিপক্ষে ওই সিরিজের পর বাংলাদেশ নিজেদের মাঠে সাতটি সিরিজ খেলেছে। যার সবকটিতেই জিতেছে স্বাগতিক দল। টানা সাত সিরিজ জেতা বাংলাদেশের আবার একই অভিজ্ঞতা হলো সেই ইংল্যান্ডের কাছেই।
সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ওয়ানড সিরিজ জিতলেও বাংলাদেশ কখনও ইংলিশদের বিপক্ষে সিরিজ জিততে পারেনি। এবার সিরিজ শুরুর আগে কোচ, অধিনায়ক, বোর্ড কর্তাদের আত্মবিশ্বাস ছিল সিরিজ জেতার। কিন্তু নিজেদের চেনা কন্ডিশনে যেন সফরকারী দল হয়ে উঠলো তামিম ইকবালের দল। ব্যাটিংবান্ধব উইকেট মানেই যেন বাংলাদেশের ভরাডুবি। ইংলিশদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের অসহায়ত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে তারা কতটা অসহায়!
দারুণ ব্যাটিং উইকেটে ইংলিশ বোলারদের তোপের মুখে বাংলাদেশের ইনিংস থেমেছে ১৯৪ রানে! ফলে ১৩২ রানে হেরে ৭ বছর পর ঘরের মাঠে সিরিজ হেরেছে লাল-সবুজ দল। মাঝের সময়টাতে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দাপট দেখালেও ইংলিশদের বিপক্ষে হতাশার গল্পই লিখতে হয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ ওয়ানডে ফরম্যাটে দাপট দেখিয়ে আসছে। বিশেষ করে নিজেদের মাঠে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। গত ৮ বছরে ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর হোম কন্ডিশনে তারা ১৪টি ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে। যার মধ্যে ১২টি সিরিজেই স্বাগতিকরা জিতেছে। শুধু ৮ বছরে দু’বার ছন্দপতন ঘটানো দলটির নাম ইংল্যান্ড।
অথচ লম্বা সময় ধরে বড় বড় দলগুলোর বিপক্ষে ধারাবাহিকতার অনন্য উদাহরণ ছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড- কেউই বাংলাদেশের কাছে পাত্তা পায়নি। তবে সেসব সিরিজ জয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল হোম কন্ডিশনের। এবারও বাংলাদেশ সেটি করতে পারতো। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ানডে বিশ্বকাপকে ঘিরে সেই পরিকল্পনায় বদল আনতে হয়ছে টিম ম্যানেজমেন্টকে। কিছুটা স্লো ও স্পিনবান্ধব উইকেটে তারা বেশ সফল হলেও স্পোর্টিং উইকেটে তেমনটা নয়। ঠিক এই কারণেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরের প্রথম দুই ম্যাচে হতাশায় মোড়ানো পারফরম্যান্স রচিত হয়েছে।
ইংলিশদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের উইকেটে স্পিনারদের কিছুটা সুবিধা থাকলেও দ্বিতীয় ম্যাচে তেমন কিছু ছিল না। বরং ব্যাটারদের জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক উইকেটই ছিল। এমন ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ইংলিশরা ৭ উইকেটে ৩২৬ রান করলেও বাংলাদেশ দলের ব্যাটারা ছিলেন ব্যর্থ।
প্রথম ওয়ানডেতে টস জিতে ব্যাটিং নেওয়া তামিম ইকবাল শুক্রবার দ্বিতীয় ম্যাচে সফরকারীদের ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। শুরুতে চাপ প্রয়োগ করলেও শেষ পর্যন্ত রান বন্যায় ভেসে যায় বাংলাদেশ। তাতে ৫ বছর পর মিরপুরের উইকেট থেকে তিনশোর বেশি রান তুলে নিয়েছে ইংল্যান্ড। জেসন রয়ের সেঞ্চুরি (১৩২) ও জস বাটলারের ঝড়ো হাফসেঞ্চুরির (৭৬) ওপর দাঁড়িয়ে সফরকারীরা ৩২৬ রানের পাহাড় গড়েছে।
কঠিন এই লক্ষ্যে খেলতে নেমে ভরাডুবির শঙ্কায় ছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ভক্তদের শঙ্কাটা অমূলক ছিল না। কেননা, ঘরের মাঠে এত রান চেজ করার ইতিহাস বাংলাদেশের নেই! শেষ পর্যন্ত শঙ্কাই সত্যি হলো। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ২০০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি ভরাডুবিতে শেষ হয়েছে। স্বাগতিকরা ১৯৪ রানে অলআউট হওয়ায় টানা ৭ সিরিজ জয়ের ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটলো।
প্রথম ওয়ানডের একাদশে স্যাম কারান ছিলেন না। দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েই বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং লাইনআপকে ভেঙে দিয়েছেন এই পেসারই। আইপিএলে সবচেয়ে বেশি ১৮ লাখ ৫০ কোটি রুপিতে তাকে কিনেছিল পাঞ্জাব কিংস। এই সময়ের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারকে পেতে পাঞ্জাব কেন এত খরচ করেছে, সেটাই যেন প্রমাণ করলেন কারান। পর পর দুই বলে লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্তকে সাজঘরে ফিরিয়েছেন। টপ অর্ডার এই দুই ব্যাটার গোল্ডেন ডাক মারতেই চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। সেই চাপ থেকে পরবর্তীতে আর কখনোই স্বাগতিকরা বের হতে পারেনি। তামিম-সাকিবের জুটিতে কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও সেই জুটি জয়ের পথ দেখাতে পারেনি। লম্বা সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা তামিম স্লো ব্যাটিং করে ৬৫ বলে ৩৫ রান করে আউট হয়েছেন। সাকিব খেলেছেন ৬৯ বলে ৫৮ রানের ইনিংস। কিন্তু টপ অর্ডারের পর মিডল অর্ডারের আর কোনও সাপোর্ট না থাকায় বাংলাদেশ দলকে থামতে হয়েছে ১৯৪ রানে। মূলত স্পোর্টিং উইকেটে খেলায় অনভ্যস্ততার কারণেই বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। প্রথম ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেছিলেন, ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আগে স্পোর্টিং উইকেটে খেলে কিছু ম্যাচ হারলেও এমন অভ্যাস তারা অব্যাহত রাখবেন।
এখন সিরিজ হারলেও বাংলাদেশের ব্যাটাররা যদি স্পোর্টিং উইকেটে খেলার অভ্যাস গড়তে পারেন, সেটিরও ইতিবাচক দিক থাকবে। আসন্ন ওয়ানডে বিশ্বকাপ ঘিরে যে প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সংমিশ্রণ ঘটাতে হলে এমন কিছুর বিকল্প নেই।
তবে দেশের বাইরে তো বটেই, দেশের মধ্যে স্পোর্টিং উইকেটেও বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। ছোট দলগুলোর বিপক্ষে কালেভাদ্রে সাফল্য এলেও বড় দলগুলোর বিপক্ষে স্পোর্টিং উইকেটে বাংলাদেশ সাফল্যহীন। যদিও সেটি স্বীকার করলেন না অধিনায়ক তামিম ইকবাল, ‘বাংলাদেশে আমরা শুধু খারাপ উইকেটেই ম্যাচ জিতছি ব্যাপারটা এমন নয়। আমরা ভালো উইকেটেও ম্যাচ জিতেছি।’