জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) আজ সড়ক পরিবহন, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুমোদন দিয়েছে।
অনুমোদিত আরএডিপি চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার চেয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা বা ৬.৮৪ শতাংশ কম।
আজ রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে এনইসি চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এনইসি সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
সভার পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, মোট সংশোধিত আরএডিপি ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা স্থানীয় উৎস থেকে এবং ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে আসবে।
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার বক্তব্য রাখেন।
সত্যজিৎ বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য আরএডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১৫৮৮টি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩৪৫টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ৩৬টি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প, ১১৫টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প এবং ৯২টি স্ব-অর্থায়ন প্রকল্প রয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পূর্বের নির্দেশনা অনুযায়ী সভায় বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী যেসব প্রকল্প শেষ পর্যায়ে এবং ন্যূনতম তহবিলে সম্পন্ন হতে পারে এবং যেগুলো থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ফল আসতে পারে, সেসব প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সালাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিলম্বের স্বাভাবিক প্রবণতা এড়াতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি) মনিটরিং করার বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে যাতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়মতো সম্পন্ন হয়, সময় ও ব্যয় বেড়ে না যায়।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো খাতে বরাদ্দ ও বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর সভায় জোর দেওয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সালাম বলেন, সামর্থের অভাব এবং অন্যান্য কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রায়ই আরএডিপিতে কম বরাদ্দ দেখতে পায়।
তিনি বলেন, আরএডিপি বাস্তবায়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এডিপি ব্যবহারের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরে অনেক প্রতিকূলতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছে, যা উন্নয়নের গতির জন্য ক্ষতিকর।
গত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহসহ সব অর্থনৈতিক সূচকও বাড়ছে।
‘স্থিতিশীলতা উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং এটি এখন বিরাজমান’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন এখন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আরও জানান, ৯ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ও পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খসড়া তৈরি করা হবে।
এডিপির আকার হ্রাস করার স্বাভাবিক প্রবণতা সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সালাম বলেন, এডিপি সংশোধন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং এটি অব্যাহত থাকবে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার জানান, বর্তমান ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে চলতি অর্থবছরের জন্য আরএডিপি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সভায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন।
পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রকল্প পরিচালকদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং একটি পুল তৈরির মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উপায় সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ জমা দিতে বলেছেন।
এ বিষয়ে সত্যজিৎ বলেন, রোডম্যাপ ও গাইডলাইন পাওয়া গেলে, বাস্তবায়নে ধীরগতির প্রবণতা ও সামর্থের অভাবকে সামগ্রিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে শেষ পর্যায়ে থাকা প্রায় ৩৩০টি প্রকল্প চলতি অর্থবছরে শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
পরিকল্পনা সচিব বলেন, ৩৩০টি প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দেশি-বিদেশি তহবিল প্রস্তুত থাকায় ওই প্রকল্পগুলো সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সত্যজিৎ বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী বরাদ্দে কিছু অমিল থাকলেও প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, পরিবেশ, নারীর উন্নয়ন খাতে আরও মানসম্মত প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন।
চলতি অর্থবর্ষের আরএডিপি অনুযায়ী, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত সর্বোচ্চ ৬৩,২৬৩.৩১ টাকা (২৫.৮২%) বরাদ্দ পেয়েছে, তারপরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩৭,৮৯৬.৭৩ কোটি টাকা (১৫.৪৭%), গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা ২৮,০০২.১৫ কোটি টাকা (১১.৪৩%), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ১৯,৯৬৯.৭১ কোটি টাকা (৮.১৫%), শিক্ষা ১৭,২২৯.৯১ কোটি টাকা (৭.০৩%), পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ ১৪,৩৯১ কোটি টাকা (৫.৮৭%), স্বাস্থ্য ১২,০৬৬.৭৬ কোটি টাকা (৪.৯৩%), কৃষি ১০,৩১৭.৭৬ কোটি টাকা (৪.২১%), শিল্প ও অর্থনৈতিক পরিষেবা ৪,৬৩০.৪৩ কোটি টাকা (১.৮৯%) এবং বিজ্ঞান ও আইসিটি ৩,৬৩৭.১২ কোটি টাকা (১.৪৮%)।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ গ্রহীতা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৪২,৭০০.৭৬ কোটি টাকা (১৭.৪৩%) নিয়ে তালিকার শীর্ষে, তারপরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২৭,৮০৩.৪৫ কোটি টাকা (১১.৩৫%), বিদ্যুৎ বিভাগ ২৭,১২৭.৪৫ কোটি টাকা (১১.০৭%), রেল মন্ত্রণালয় ১৩,১১৭.৬২ কোটি টাকা (৫.৩৫%), পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১২,১৯২.৭৫ কোটি টাকা (৪.৯৮%), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১১,৪১৫.৫১ কোটি টাকা (৪.৬৬%), স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগ ৯,৩৪৫.৪৯ কোটি টাকা (৩.৮১%) পেয়েছে।