মেকেরেনের লাফিয়ে উঠা বলটা সাকিবের গ্লাভস ছুঁয়ে কিপারের হাতে জমা হতেই ইডেনের গ্যালারিতে ‘ভুয়া-ভুয়া’ দুয়োধ্বনি। দুদিন আগে যা শুরু হয়েছিল ঢাকায়। বাড়ির পাশের ইডেনেও তা চলমান। ডাচদের কমলা উৎসবের এপিটাফ লিখা হয়ে যায় সাকিবের ওই আত্মসমর্পণে।
চার বল পর মিরাজ ও দশ বল পর মুশফিক ড্রেসিংরুমের পথ ধরলে গোটা গ্যালারিতেই সেই দুয়োধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ ওভার আগে মাহমুদউল্লাহ হাল ছেড়ে দিলে খালি হতে থাকে গ্যালারি।
বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগানে যারা সেই তপ্ত দুপুর থেকে গ্যালারি মাতিয়ে আসছিলেন, প্রিয় ক্রিকেটারের জন্য গলা ফাঁটিয়েছিলেন তাদের কণ্ঠেই কতসব অশ্রাব্য কথন! ভাগ্যিস বিশ্বকাপের এই ম্যাচটা মিরপুরে হয়নি। নয়তো ২০১১ ফিরে আসত ২০২৩ এ! যেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অলআউট হওয়ায় টিম বাসে ঢিল ছুঁড়েছিল সমর্থকরা। আজ অবশ্য ইডেনে তেমন কিছু হয়নি। সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের পথ আটকে দিয়েছিল। কিন্তু ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগানে ইডেন পাড়া মুখরিত থাকায় সাকিবরা সেই ‘ধিক্কার’ এড়াতে পারেননি নিশ্চিতভাবেই।
বিশ্বকাপে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণী ম্যাচ ছিল এটি। টিকে থাকতে চার ম্যাচে চার জয় চাই, এমন সমীকরণে শুরুতেই নেদারল্যান্ডসকে পাওয়া বড় কিছু। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেওয়া, ছন্দে ফেরা, ব্যাটসম্যানরা রান করা, বোলাররা উইকেট নেওয়া…সব সুযোগ ছিল এই ম্যাচকে ঘিরে।
কিন্তু বিশ্বকাপে নিজেদের আরেকটি নিষ্প্রভ হয়ে থাকার দিনে লাল সবুজের স্বপ্নসারথিরা হেলায় হারালো সব সুযোগ। স্কোরবোর্ডে মাত্র ২২৯ রানের পুঁজি নিয়ে নেদারল্যান্ডস বোলিংয়ে যে প্রাণপণ লড়াই করলো তারই ফলাফল ৮৭ রানের জয়। বাংলাদেশকে ১৪২ রানে অলআউট করে নেদারল্যান্ডস বুঝিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোটা কোনো ‘অঘটন’ ছিল না।
টসের পর রমিজ রাজা বলেছিলেন, উইকেট সলিড। কিন্তু মাঠে সেই চিত্র মেলেনি। উল্টো বল ধীর গতির ছিল। যা বাংলাদেশের জন্য আদর্শ ছিল। কিন্তু ডাচদের স্পিন ও পেস আক্রমণ ব্যাটসম্যানরা সামলাতে হিমশীম খেয়েছে। ১২ বলে ৩ রান করে লিটন রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে কট বিহাইন্ড হন। যে শটের কোনো ব্যাখ্যা পায়নি কেউ। তানজিদ পথ ভোলেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে। এরপর বাংলাদেশ শিবিরে আক্রমণ চালান পেসার মেকেরেন। শান্তকে দ্বিতীয় স্লিপে তালুবন্দি করানোর পর সাকিবকে বুক তাক করা বাউন্সে উইকেটের পেছনে তালুবন্দি করান। দুর্বলতার জায়গায় আক্রমণ করেই সাকিবকে ফিরিয়ে সফল মেকেরেন। শেষ ম্যাচের পর ঢাকায় ফিরে নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন যা ফুটে উঠেনি তার ১৪ বলে ৫ রানের ইনিংসে।
এরপর মুশফিকের উইকেট উপচে ফেলেন দারুণ এক স্লোয়ারে। মাঝে সর্বোচ্চ ৩৫ রান করা মিরাজকে ফুলার লেন্থ বলে উইকেটের পেছনে তালুবন্দি করান বাস ডি লিড। এরপর ভরসা ছিলেন কেবল মাহমুদউল্লাহ। তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন মাহেদী। দুজনের ৭১ বলে ৩৮ রানের জুটি খানিকটা আশা দেখিয়েছিল। কিন্তু অহেতুক রান আউটে তাদের জুটি ভাঙলে সব শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের।
সেখান থেকে আর হারানোর কিছুই ছিল না বাংলাদেশের। মেকেরেন তাসকিনকে ডি লিডের হাতে তালুবন্দি করালে গ্যালারির এক কোনে আর ইডেনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১১ ডাচ স্বপ্নসারথির কমলা উৎসব শুরু হয়ে যায়। তা তাদের জয়ের ক্যানভাসে রংধনুর বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ইনিংসের শুরু ও মাঝপথে যে হাসির খোঁজে ছিল কমলা শিবির, শেষটায় খুঁজে পেয়েছে ফন বিকের ব্যাটে। দুই চার, এক ছক্কায় শেষটায় মাহেদীর ওভারে যে ঝড় তুলেছিলেন ভিক তাতে ইনিংসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ১৭ রান চলে আসে। তাতে বড় প্রশ্নও উঠছে। মিতব্যয়ী মিরাজ (৪ ওভারে ১৭) ও দ্রুতগতির তাসকিনের ওভার বাকি থাকাতেও কেন শেষ ওভারে মাহেদীর হাতেই বল উঠল! যদিও ওই ওভারের আগে ৬ ওভারে ২৩ রানে ১ উইকেটের কারণে অধিনায়কের আত্মবিশ্বাস না রাখার কারণও ছিল না।
যে অবস্থা থেকে উঠে এসে ডাচরা লড়াকু পুঁজি পেয়েছে সেজন্য তাদের কৃতিত্ব দিতে হবে। ৪ রানে ২ উইকেট থেকে ৬৩ রানে ৪ উইকেট! এরপর ১৮৫ রানে ৬টি। শেষমেশ ২২৯ এ অলআউট। তাদের ইনিংসের সারমর্ম এভাবেও টানা যায়, রোলার কোস্টার রাইড! কখনো ওপরে উঠবে তো কখনো নিচে। যে ধারাবাহিকতার দরকার ছিল তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভাগ্যপ্রসূত হওয়ায় তাদের ইনিংস লম্বা হয়েছে।
মোস্তাফিজের বলে অধিনায়ক এডওয়ার্ডস ৩ বলের ব্যবধানে শূন্যরানে দুইবার জীবন পেয়েছেন লিটন ও মুশফিকের হাতে। জীবন পেয়ে এডওয়ার্ডস অধিনায়কোচিত ৬৮ রানের ইনিংস খেলে দলকে নিরাপদ স্থানে রেখে আসেন। বাংলাদেশকে হারাতে ওইটুকু রানই যে যথেষ্ট তা হয়তো কল্পনাতেও ভাবেননি তারা।
স্বল্প পুঁজি নিয়ে লড়াইয়ের জন্য নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সঙ্গে যে তুখোড় ফিল্ডিংয়ের প্রয়োজন হয় মাঠে নেদারল্যান্ডস সেই প্রদর্শনী দেখিয়েছে। স্লিপে ফন বিকের শান্তর ক্যাচ, বৃত্তের ভেতরে আরিয়ান দত্তের ঝাপাঝাপি কিংবা সরাসরি থ্রোতে সিব্রান্ডের রান আউট সবই বুঝিয়ে দিচ্ছিল জয় পেতে কতোটা ক্ষুধার্থ তারা।
‘আওয়ার এইম ইজ অলওয়েজ নেক্সট ওয়ার্ল্ডকাপ।’ – গ্যালারির সাদা পোস্টারের সেই চাওয়া মনে করিয়ে দেয় চার বছর আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের প্রতিশ্রুতি। পরবর্তী চার বছরের জন্য সেই চাওয়া দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো!