মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন

হেড রূপকথায় অস্ট্রেলিয়ার শিরোপার রাত

  • আপডেট সময় সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৩, ৩.২৩ এএম
  • ৬৬ বার পড়া হয়েছে

বিশ্বকাপের আগে হুট করে ত্রেভিস হেডের ইনজুরি। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া জানতো, হেড তাদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে ১৭৪ বলে ১৬৩ রান করে দলকে জিতিয়ে ম্যাচ সেরা। তাই চোটে পড়া হেডকে নিয়েই বিশ্বকাপ দল ঘোষণা।

পাঁচ ম্যাচ পর দলে ফিরে প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি হেডের। বিশ্বকাপ অভিষেকে ৬৭ বলে করেন ১০৯ রান। আবার ম্যাচ সেরা। সেঞ্চুরি করলেন শেষ ম্যাচেও। একটু আগে বিশ্বকাপের ফাইনালে। ১২০ বলে ১৩৭ রান করে আবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ। রূপকথার গল্প লিখতে আর কি চাই।

ভারতের নরেন্দ্রে মোদী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রূপকথার এক ইনিংস খেলে একাই হারালেন প্রতাপশালী ভারতকে। ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লিখে নিলেন নিজের নাম। অস্ট্রেলিয়াকে দিলেন বিশ্বকাপের ষষ্ঠ মুকুট।

আগে ব্যাটিং করতে নেমে ২৩৯ রানের বেশি করতে পারেনি ভারত। জবাবে অস্ট্রেলিয়া হেডের চিত্তাকর্ষক ইনিংসে ৬ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়, ৭ ওভার হাতে রেখে।

এক দল টানা দশ জয়ে ফাইনালে। আরেক দল প্রথম দুই হারের পর টানা আট জয়ে শিরোপার থেকে এক পা দূরে। ফাইনাল নিয়ে সতর্ক ছিল দুই দলই। জানতো, একটু পা পিছলে গেলেই পিছিয়ে যেতে হবে। ভারত ঘরের মাঠে তেমন রাত কাটালো। টানা ১০ ম্যাচ জেতার পরেও ব্যর্থ হয়েছে ভারতের ব্যাটিং ও বোলিং। অস্ট্রেলিয়া ছন্দ পেতে সময় নিলেও বড় মঞ্চে কিভাবে পারফর্ম করতে হয় তা যেন বুঝিয়ে দিলো হিসেব কষে।

২০০৩ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি হলো ২০২৩ এ। সেবার ভারত সব ম্যাচ জিতে ফাইনালে গিয়ে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছে। এবারও তাই। ২০ বছর আগের বদলা নেওয়া হলো না। ১২ বছর পর বিশ্বকাপ জয়ও হলো না। ১০ বছর ধরে আইসিসি ট্রফি না পাওয়ার খরা কাটলো না। দেড়’শ কোটির ভারত স্রেফ স্তব্ধ, নিরুত্তাপ।

ভারতের মাটিতে বসে ভারতের খেলা দেখার ভিন্ন রকম রোমাঞ্চ আছে। খেলার দিকে গভীর মনোযোগ না দিলেও হবে। গ্যালারি যখন চিৎকার, উল্লাস, উদ্দীপনায় মেতে উঠবে ধরে নিতে হবে ভারত ম্যাচে আছে। আর যখন গ্যালারিতে নিস্তব্ধতা, পিনপতন নীরবতায় বুঁদ তখন বুঝে যাবেন ভারত ম্যাচে নেই। নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শকদের উপস্থিতিতে তেমন আবহ তৈরি হয়েছে। দুপুরে কামিন্স, স্টার্ককরা যখন আগুন ঝরাচ্ছিলেন তখন স্টেডিয়াম শান্ত। আবার রোহিত-বিরাটের প্রতি আক্রমণে স্টেডিয়ামে গগণবিদারী চিৎকার। কৃত্রিম আলোয় সামি-বুমরাহর তোপে স্টেডিয়ামে কিচিরমিচির আওয়াজে ভরপুর।

ঠিক উল্টো চিত্র যখন অস্ট্রেলিয়ার দাপটে একটু একটু করে ম্যাচ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে টিম ইন্ডিয়া। শেষমেশ গ্যালারিতে আর নীল উৎসব হয়নি। নীল ঢেউ থেমে যায় অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ শিরোপায়।

ধারণা করা হচ্ছিল টস ভাগ্য ম্যাচে প্রভাব ফেলবে। কেননা বিশ্বকাপে এই স্টেডিয়ামে আগে অনুষ্ঠিত হওয়া চার ম্যাচের তিনটিতেই পরে ব্যাট করা দল জিতেছে। কিন্তু প্যাট কামিন্স টস জিতে বোলিংয়ে সিদ্ধান্ত নিলে হাসি ফুটে রোহিতের মুখে। কেননা ব্যবহৃত উইকেটে আগে ব্যাটিং করার পরিকল্পনা ছিল তার। এই উইকেটে পাকিস্তানকে আতিথেয়তা দিয়ে ৭ উইকেটে হারিয়েছিল। তাই উইকেট সম্পর্কে আগাম ধারণা ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্সে সব হিসেব-নিকেশ ওলট-পালট।

শুরুর দশ ওভারে ভারত যে উড়বে তা ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল আগের ম্যাচগুলো থেকে। রোহিত-গিলের জুটি বেশিক্ষণ টিকেনি। স্টার্কের শর্ট বল উড়াতে গিয়ে গিল ক্যাচ দেন মাত্র ৪ রানে। কিন্তু রোহিত পেছনে না ফিরে প্রতি আক্রমণে গিয়ে রান তোলেন। পুল শটে ছক্কা ছড়িয়েছেন। কাভার ড্রাইভে পেয়েছেন চার। এগিয়ে এসে বোলারের মাথার ওপর দিয়েও মেরেছেন ছক্কা, চার। স্পিনারকে কাট করে বল পাঠিয়েছেন সীমান্তে। তাতে ১০ ওভারে ৮ রানরেট করে ৮০ রান তুলে নেয় ভারত। কিন্তু ২ ব্যাটসম্যান ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে।

পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে ভারত হারায় রোহিতের উইকেট। ম্যাক্সওয়েলকে পাওয়ার প্লে’তে বোলিংয়ে এনে বাজি ধরেছিল অস্ট্রেলিয়া। তা কাজে লেগে যায়। ১৭ রান খরচ করে ম্যাক্সওয়েল পান রোহিতের উইকেট। তার বল উড়াতে গিয়ে ডিপ কভারে ক্যাচ তোলেন। কভার থেকে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে সেই ক্যাচ নেন হেড। ম্যাচের এপিটাফ ওই ক্যাচেই লিখা হয়ে যায় বলে কথা উঠতে থাকে।

সেখান থেকেই পথ ভুলতে শুরু করে ভারত। এরপর আর ম্যাচে ফেরেনি স্বাগতিকরা। ১১-৫০, এই ৪০ ওভারে তাদের রানরেট এক মুহূর্তের জন্য পাঁচের কাছাকাছিও পৌঁছায়নি। সর্বোচ্চ রানরেট ছিল ৪.৫০।

কতটা নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খল বোলিং অস্ট্রেলিয়া করেছে তা বোঝা যায় আরেকটি পরিসংখ্যানে। ১১-৪০ এই ওভারগুলোতে মাত্র ২ বাউন্ডারি হজম করে। সব মিলিয়ে শেষ ৪০ ওভারে বাউন্ডারি আসে ৪টি।

রোহিতের আউটের চার বলের ভেতরেই কামিন্সের শিকার আইয়ার। ডানহাতি পেসারের দারুণ অফ কাটারে আইয়ার ৪ রানে ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে। ৫ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ভারত তখন প্রবল চাপে। বিরাট ও লোকেশ দলের হাল ধরলেও অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে তারা তেমন কিছু করতে পারেননি। বৃত্তের ভেতরে রান আটকে রেখেছিলেন ফিল্ডাররা। সীমান্তে তারা ছিলেন অতন্ত প্রহরী। তাই তো ধারাভাষ্যে বসে হার্শা ভোগলে বলতে বাধ্য হন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সীমান্ত যেন কঠিন নিরাপত্তা দিয়ে সাজানো জেলখানা।’

সত্যিই তাই। ওয়ার্নার, হেড, লাবুশানে যেভাবে সীমানায় ঝাপিয়ে পড়ে রান বাঁচিয়েছেন তাতে খেলাটা মেলবোর্নে বা সিডনিতে হলে করতালি পেতেন।

রান ফোয়ারায় থাকা বিরাট আরেকটি ফিফটি তুলে নেন। স্টার্ককে ফ্লিক, কাট ও স্ট্রেইট ড্রাইভে পরপর তিন চার মেরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আজও তার ব্যাট থেকে বড় কিছু আসছে। কিন্তু ফিফটির পর আলগা এক শটে শেষ তার মিশন। কামিন্সের বুক বরাবর এক বাউন্সার আলতো খেলতে গিয়ে উইকেটে টেনে বোল্ড হন ৫৪ রানে। হতাশায় কয়েক মুহূর্ত ক্রিজেই দাঁড়িয়ে থাকেন কোহলি। আর গোটা স্টেডিয়ামে দীর্ঘশ্বাস, নীরবতা। ভেঙে যায় কোটি কোটি ভারতীয় সমর্থকের বুক। ব্যাট হাতে কোহলির বিশ্বকাপ শেষ হলো ৭৬৫ রানে। বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড আগেই করেছিলেন। সেটাকে ফাইনালে আরও সমৃদ্ধ করলেও শেষ হাসিটা হাসতে পারেননি বিরাট।

তার আউটের পর লোকেশ, জাদেজার ওপর ভরসা থাকলেও তারা বেশিদূর যেতে পারেননি। দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করা লোকেশ আউট হন স্টার্কের দারুণ এক কাটারে। বল ক্রিজে পড়েই শার্প টার্ন করে। উইকেটে ডাবল পেস থাকায় লোকেশ শট অফার করেননি। কিন্তু বল তার ব্যাটের চুমু খেয়ে যায় উইকেটের পেছনে। ১০৭ বলে তার ৬৬ রানের ইনিংস থামে সেখানে। অপরপ্রান্তে হ্যাজেলউডের বলে জাদেজা ৯ রান করে খোঁচা দিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন।

সূর্যকুমার যাদব যখন ক্রিজে এসেছিলেন সঞ্জয় মঞ্জেরেকার বলেন, এই উইকেট স্কাইয়ের জন্য নয়।’ ঠিক তা-ই হয়েছে। দ্রুতগতির বল খেলতে অভ্যস্ত সূর্যকুমার তালগোল পাকান অস্ট্রেলিয়ার ধীর গতির বোলিংয়ে। টাইমিংয়ে গড়বড় করে কামিন্সের বাউন্সারে উইকেটের পেছনে যখন ক্যাচ দেন তখন তার রান ২৮ বলে ১৮। শেষ জুটিতে ১৫ বলে ১৩ রান তুলে কুলদীপ ও সিরাজ দলের রানকে নিয়ে যান ২৪০-এর ঘরে। যা পর্যাপ্ত ছিল না অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ শিরোপার জন্য।

ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয়া বোলিংয়ে ছিল একেবারেই আঁটসাঁট। ধীরগতির উইকেটে যেভাবে আক্রমণে যাওয়া দরকার ছিল কামিন্স, স্টার্ক, হ্যাজেলউডরা সেভাবেই এগিয়েছেন। ৫৫ রানে ৩ উইকেট নিয়ে স্টার্ক ছিলেন দুর্দান্ত। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোটার ১০ ওভার শেষ করা কামিন্স কোনো বাউন্ডারি হজম না করে রেকর্ড গড়েছেন। স্পিনে হাত ঘুরিয়ে ম্যাক্সওয়েল ও জাম্পাও পেয়েছেন ১টি করে উইকেট। সম্মিলিত এ পারফরম্যান্সের সুবাদে ভারত প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অলআউটের তিক্ত অভিজ্ঞতা পায়। সঙ্গে বিবর্ণ ব্যাটিং পারফরম্যান্সে শিরোপাও হারায়।

শেষ বিশ্বকাপ যেখানে শেষ হয়েছিল এবারের ফাইনাল মাঝপথে সেখানেই দাঁড়িয়ে। নিউ জিল্যান্ড আগে ব্যাটিং করে ২৪১ রান করেছিল। পরে সেই ম্যাচ সুপার ওভারে জেতে ইংল্যান্ড। এবার তেমন কিছু হয়নি। অস্ট্রেলিয়া বড় মঞ্চে নিজেদের স্নায়ু আরও একবার স্থির রাখলো। ভারতকে স্রেফ উড়িয়ে অনায়েসে লক্ষ্য তাড়া করে।

নতুন বলে বুমরাহ ও সামিকে সামলাতে কিছুটা সমস্যা হলেও থিতু হওয়ার পর অসি ব্যাটসম্যানদের আটকানো যায়নি। ওয়ার্নারকে স্লিপে তালুবন্দি করিয়ে বিশ্বকাপে নিজের উইকেট ২৪ এ নিয়ে যান সামি। এরপর বুমরাহ তুলে নেন মিচেল মার্শ ও স্টিভেন স্মিথের উইকেট। ৬ ওভারে ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে অসি শিবিরেও দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু দুর্দান্ত হেডের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে গ্যালারির নীল উৎসব থেমে যায় নিমিষেই। শুরুতে থিতু হতে সময় নিয়েছিলেন হেড। এরপর ছুটেছে তার ব্যাট। এক পর্যায়ে আক্রমণে এলোমেলো করে দেন বোলিং আক্রমণ। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে সাজান সেঞ্চুরির ইনিংস। তিন অঙ্কের মাইলফলক ছুঁয়ে হেড বসেছেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, অরভিন্দ ডি সিলভা, রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও মাহেলা জয়াবর্ধনের পাশে। তারা প্রত্যেকেই বিশ্বকাপের ফাইনাল রাঙিয়েছেন সেঞ্চুরিতে। হেডকে আরেকটু বেশি বাহবা দিতে হবে। কেননা রান তাড়ায় তার সঙ্গে সেঞ্চুরি আছে কেবল অরবিন্দ ডি সিলভার। ১২০ বলে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে শিরোপায় চুমু খেয়েছেন। যে রূপকথার গল্প লিখেছেন ১৫ চার ও ৪ ছক্কায়।

বাঁহাতি ওপেনারকে যোগ্য সঙ্গ দেন লাবুশানে। দুজনের ১৯২ রানের জুটিতে অস্ট্রেলিয়ার হেক্সা মিশন সাকসেসফুল। লাবুশানের ১১০ বলে ৫৮ রানের ইনিংসটি পরিস্থিতি বিবেচনায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস রেজাল্ট।

ইটের পর ইট সাজিয়ে ভারতের দলীয় সাফল্যের ইমারত নির্মাণ করার পেছনের কারিগর রোহিত, বিরাট, সামি, রাহুল, আইয়াররা। শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মঞ্চে ব্যক্তিগত অর্জনে তারা সবাইকে ছাড়িয়ে। ৭৬৫ রান করে বিরাট সেরা ব্যাটসম্যান। ২৪ উইকেট নিয়ে সামি সেরা বোলার। কিন্তু দলীয় অর্জনের শেষ পরীক্ষায় তারা হার মানলো অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ শিরোপা অর্জনের রাতে। আরও ৪ বছরের অপেক্ষা বাড়ল ভারতের। অস্ট্রেলিয়া ৮ বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধার করলো।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort