তাহমিদ আহমেদ : বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হয়। এই মানুষদের একটি বড় অংশ হকার হিসেবে রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, মার্কেটের সামনে এবং অন্যান্য জনবহুল এলাকায় ব্যবসা করে থাকে। হকাররা সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের নিজস্ব দোকান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নেই। যদিও তারা জীবিকার তাগিদে কাজ করে, তবে ফুটপাত বা সড়ক দখল করে ব্যবসা পরিচালনার ফলে জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং ট্রাফিক জ্যামসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এই সমস্যা নিরসনে সরকারকে হকারদের পুনর্বাসনের একটি সুসংগঠিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সরাসরি উচ্ছেদ না করে, মানবিক ও পরিকল্পিত উপায়ে সমস্যার সমাধান করা উচিত। প্রথমত, শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে হকারদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এই তালিকায় তাদের নাম, বয়স, পেশার ধরন, আয়, বসবাসের ঠিকানা ও স্থানে ব্যবসা পরিচালনার সময় উল্লেখ থাকবে।
দ্বিতীয়ত, হকারদের জন্য নির্দিষ্ট বিক্রয় এলাকা (designated vending zone) নির্ধারণ করা উচিত। এই এলাকা হবে যানবাহন চলাচলের বাহিরে, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করতে পারবে এবং যানজট হবে না। শহরের পার্কিং এরিয়া, পরিত্যক্ত খালি জায়গা অথবা বাস টার্মিনালের আশেপাশে এমন জায়গা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, সরকার স্থানীয় সিটি করপোরেশনের অধীনে একটি “হকার পুনর্বাসন বোর্ড” গঠন করতে পারে। এই বোর্ড হকারদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক পরামর্শ দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তুলবে। এ ছাড়া আধুনিক হকার মার্কেট তৈরি করে কম ভাড়ায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, হকারদের জন্য ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন চালু করা উচিত। এতে করে প্রতিটি হকারের পরিচয়পত্র ও লাইসেন্স থাকবে এবং কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে। পাশাপাশি তাদের আয়ের উপর একটি সামান্য হকার ট্যাক্স আরোপ করে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোও সম্ভব।
পঞ্চমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ট্রাফিক পুলিশদের সহযোগিতায় নিয়মিত অভিযান চালিয়ে হকারদের নির্ধারিত এলাকা ব্যতীত অন্য কোথাও বসতে না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এই অভিযান যেন মানবিক হয় এবং আগে থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, সড়ক ও ফুটপাত ব্যবহারে নাগরিকদের সচেতন করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রচারণা, পোস্টার, ব্যানার, স্কুলে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে যে হকারদের পুনর্বাসন না করে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা মানবিক নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, হকারদের বিকল্প পেশায় যুক্ত করার উদ্যোগ। অনেক হকার ইচ্ছা থাকলেও দক্ষতার অভাবে অন্য পেশায় যেতে পারেন না। সরকার তাদের স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে ছোট চাকরি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা কৌশলভিত্তিক পেশায় যুক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও এনজিওদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
হকারদের অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন, কারণ গ্রামে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই সরকারকে গ্রামে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ শিল্প উন্নয়ন, কৃষিনির্ভর ক্ষুদ্র উদ্যোগ এবং রিমোট ওয়ার্ক সুবিধার মাধ্যমে শহরমুখী চাপ কমানো সম্ভব।
সবচেয়ে জরুরি হলো – নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অনেক সময় হকাররা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাস্তায় ব্যবসা চালায়, যা শহর ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তোলে। যদি রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো বন্ধ হয় এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত দৃঢ় হয়, তবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
হকার সমস্যার সমাধান কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা এবং হকারদের সহযোগিতায় একটি সুশৃঙ্খল ও যানজটমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। এতে করে শহর হবে আরও বাসযোগ্য, নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব।
তাহমিদ আহমেদ
শিক্ষার্থী, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ