বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি।
নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন মানুষ। অনেকের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে-এক কথায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। বন্যা কবলিতদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সিলেট ও সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
পানি ঢুকে পড়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও। বিদ্যুৎ স্টেশন ডুবে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পানি প্রবেশ করায় ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়।
জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাও ছিল পানিবন্দি। পানি বাড়ছে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলায়ও। সিলেট নগরীর অনেক এলাকায়ও পানি প্রবেশ করেছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবি) আড়াইশর বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে জেলায় বন্যায় আটকা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২১ শিক্ষার্থী।
এছাড়া মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও ভোলার নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে ভুক্তভোগীরা বলেছেন, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না।
গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী পশ্চিম ইচলি গ্রামের বয়োবৃদ্ধা উম্মে সালমা জানান, ‘হামরা পানিতে ভাসি আছি। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাঁচি আচি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই। তোমরা খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামারগুলার জইন্যে কিছু করেন।’
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন। শুক্রবার তিনি জানান, বন্যার্তদের জন্য নগদ ২০ লাখ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
এর আগে সাড়ে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, বন্যার্তদের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তবে তাদের নিয়ে আসার জন্য সেই পরিমাণ বাহন নেই।
জানা গেছে, সুরমা ও যদুকাটায় একদিনে অভাবনীয় পরিমাণে বেড়েছে বানের পানি। এরমধ্যে যদুকাটায় ২৪ ঘণ্টায় ২২২ সেন্টিমিটার বা প্রায় ৫ হাত পানি বাড়ে। সুরমার পানি বাড়ে ১২০ সেন্টিমিটার বা ২ হাতের বেশি। এতে শুধু মাঠ-ঘাট নয়, পানির নিচে চলে গেছে বসতবাড়ি।
বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বন্যার প্রধান কারণ দেশের ভেতরে আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে অতি ভারি বৃষ্টি। কোনো অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা স্থানীয় বন্যার সৃষ্টি করে। আর ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ১০ দিনব্যাপী বন্যার বৃষ্টি করে। সরকারি সংস্থা বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
সুনামগঞ্জেরই ছাতকে হয়েছে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি। একই জেলার লরের গড়ে ৩২০ মিলিমিটার। সিলেটের জাফলংয়ে ২৬৮ মিলিমিটার আর লালাখালে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যার বড় একটি কারণ ভারতের সন্নিহিত পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টি ও ঢল। সিলেট সংলগ্ন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার।
একই রাজ্যের শিলংয়ে ১০১, আসামের গৌহাটিতে ৪২ আর ধুব্রিতে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে আগের দিন (বৃহস্পতিবার) বৃষ্টি হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার। আসামের ধুব্রিতে ৬৯ মিলিমিটার। এসব রাজ্যের বৃষ্টি পানি আপার মেঘনা অববাহিকার সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্য নদী হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জে ঢোকে। এর ফলে এই অঞ্চল এখন বন্যায় ভাসছে।
উল্লিখিত বৃষ্টি পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের ১০টি নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর, ধরলা, তিস্তা, সুরমা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও ভুগাই। এগুলোর মধ্যে বিপৎসীমার সবচেয়ে উপরে আছে যদুকাটা সুনামগঞ্জে।
এটি বিপৎসীমার ১৫৪ সেন্টিমিটার উপরে আছে। এরপরই সুরমা সুনামগঞ্জে বিপৎসীমার ১২০ সেন্টিমিটার উপরে আছে। সিলেটে সুরমা আছে বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপরে। উত্তরের নদী ব্রহ্মপুত্র হাতিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপরে আছে। এটি চিলমারীতেও বিপৎসীমার উপরে আছে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, সিলেট অঞ্চলে আসলে এই মুহূর্তে ‘ডাবল’ (দুটি) বন্যা হচ্ছে। সুরমা-সুনামগঞ্জে এখন যে উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে তা ভয়ংকর রূপে আছে। এটি কালই (আজ) অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রবাহিত হতে পারে, যদি গত ২ দিনের মতো পানি আসার প্রবণতা অব্যাহত থাকে।
এফএফডব্লিউসি জানায়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের কিছু স্থানে মাঝারি থেকে ভারি আবার কোথাও অতি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এরফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমোর, সুরমা, কুশিয়ারা ও গঙ্গা-পদ্মাসহ সব প্রধান নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, দেশের সব নদ-নদীর পানির সমতলই বাড়ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় একদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা, অন্যদিকে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। একই সময়ে বন্যা জামালপুর জেলায়ও বিস্তার লাভ করতে পারে।