নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ি, কিশোরগ্যাং লিডার ও হত্যাসহ কয়েকটি মামলার আসামী টাইগার ফারুক ওরফে চিকনা ফারুক ও তার ৬ সহযোগিকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
রোববার (১৬ অক্টোবর) সকালে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মহসেন এর আদালত তাদের জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। চিকনা ফারুকের ৬ সহযোগি হচ্ছে-ধর্ষণ, ছিনতাইসহ একাধকি মামলার আসামি মোঃ জসিম হোসেন ওরফে ইয়াবা জসিম (৩৮), কিশোর গ্যাং ও হত্যা মামলার আসামি আরাফাত রহমান বাবু ওরফে ফেন্সি বাবু (৩০), মাদক মামলার আসামি মিলন হোসেন (৩০), ছিনতাইকারী সোহেল (৩২), মোঃ শরীফ হোসেন (৩০) ও মোঃ সিফাত হোসেন (২৮)।
নাসিকের সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেনের কার্যালয়ে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলাও আসামী তারা প্রত্যেকে। এই মামলায় রোববার স্থায়ী জামিনের জন্য আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলে আদালত শুনানী শেষে আসামীদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরআগে আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে অস্থায়ী জামিন নিয়ে এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
নারায়ণগঞ্জ আদালতের পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: আসাদুজ্জামান জানান, সকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজ ী মহসেন আদালতে হাজির হয়ে আসামীরা স্থায়ী জামিন প্রার্থনা করেন। আদালত জামিন না মঞ্জুর করে আসামীদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এলাকার তথ্যমতে, মাদক ব্যবসায়ি ও সন্ত্রাসী টাইগার ফারুক এর ১০ সহযোগি বিভিন্ন সময়ে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ পুলিশ এবং র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। চিকনা ফারুক নিজেও হত্যা মামলায় একবার ও ডাকাতি মামলায় একবার গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটে। জামিনে বেরিয়ে শুরু করে আবার তার অপকর্ম। তার বাহিনীর অত্যাচারের এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ।
সবশেষ ২৪ আগষ্ট সন্ধ্যায় মিজমিজি তেরা মার্কেট এলাকাস্থ নাসিক ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলহাজ্ব আনোয়ার ইসলামের নিজ বাড়িতে অবস্থিত কার্যালয়ে মাদক সিন্ডিকেটর অন্যতম হোতা টাইগার ফারুকের নেতৃত্বে দেড় থেকে দুইশত সন্ত্রাসী বাহিনী দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এসময় সন্ত্রাসী বাহিনীরা কাউন্সিলরের বাড়িতে তান্ডব চালায় এবং কাউন্সিলরের লোকজনকে মারধর করে। এতে এলাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় ২৫ আগস্ট সকালে নাসিক ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবিদ হাসান রাকিব বাদী হয়ে চিকনা ফারুককে প্রধান আসামী করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা (যার নং-৪৫) দায়ের করেন।
এদিকে কাউন্সিলর কার্যালয়ের হামলার পর টাইগার ফারুক ও তার বাহিনীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে।
এলাকাবাসী জানায়, টাইগার ফারুকের ভাই জসিম চিহ্নিত ছিনতাইকারী। ছিণতাই করতে গিয়ে সে হাতে নাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার করে কারাগারে যায়। পরে জামিনে বেরিয়ে ফারুকের শেল্টারের আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে জসিম। টাইগার ফারুকের নেতৃত্বে একটি বাহিনী রাতে বেলা ছিনতাই, মাদক ব্যবসা করছে বীরদর্পে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টার থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস করে না।
স্থানীয় আওয়ামীলীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে টাইগার ফারুক আওয়ামীলীগের প্রার্থী শামীম ওসমানের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করে ধানের শীর্ষ এর ক্যাম্প করে। তার বাবা আবু সাইদ ছিল আদমজী জুট মিলস জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি। ফারুকের চাচা আমির হোসেন ওরফে শুটার আমির ওরফে বন্দুক আমির জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের প্রচার সম্পাদক ছিল। বর্তমানে তার ছোট ভাই জুয়েল রানা নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সহসভাপতি। এবং হেফাজতের মামলার আসামী। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের ধানের শীষের নির্বাচন করে টাইগার ফারুক ও তার বাপ চাচারা। আদমজী জুট মিলস চলাকালীন তৎকালীন নিউ কলোনী ১নং নতুন গেইটে আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থী শামীম ওসমানের নৌকার প্রতীক ভেঙ্গে ফেলে টাইগার ফারুক। এবং ওই নির্বাচনে শামীম ওসমান পরাজিত হওয়ার পর আগুন দিয়ে নৌকার ক্যাম্প জ্বালিয়ে দেয় ফারুক।
বিএনপি সরকারের পতনের পর পিঠ বাঁচাতে কৌশলে আওয়ামীলীগের শিবিরে মিশে যায় টাইগার ফারুক। চতুর ফটকাবাজ ফারুক নিজেকে এখন যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। মাদক বিক্রির টাকা খরচ করে শীর্ষ নেতাদের সাথে কৌশলে ছবি তুলে প্রচার করে সে যুবলীগ নেতা। এই সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ফারুক মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। আদমজী ইপিজেডে ব্যবসার করার অজুহাতে ভেতরে ভেতরে চলে তার মাদক ব্যবসা। যার কারণে রাতরাতি সে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের জমি কিনে সেখানে বহুতল বিল্ডিং বানিয়েছে।
টাইগার ফারুক সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি টিসি রোডস্থ বৈশাখী কুঞ্জের বিপরীত দিকে বিএনপির হযরত আলীর দোতলা বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় যুবলীগের কথিত কার্যালয় বানায়। বর্তমানে ফারুক হত্যা মামলার আসামী। এক পযায়ে চলতি বছরের গত ১০ মার্চ কুমিল্লা ডিবি পুলিশের হাতে ফেনসিডলসহ গ্রেপ্তার হয় টাইগার ফারুকের এক সদস্য আলমগীর। ২ এপ্রিল রাতে ঢাকার পল্টনে র্যাব-৩ এর হাতে গ্রেপ্তার হয় টাইগার ফারুকের ক্যাশিয়ার মিলন ও সহযোগি। তাদের কাছ থেকে ১৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। ১৬ এপ্রিল বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড থেকে টাইগার ফারুকের অন্যতম সহযোগি রাকিবসহ ৫ জনকে ১৮ কেজি গাঁজা ও ৯৬ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩। ফারুকের এই সহযোগিরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ফারুকের নাম আলোচনায় চলে আসে মাদক সম্রাট হিসেবে।
সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ টাইগার ফারুকের কথিত যুবলীগ অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু কয়েকদিনের মাথায় আবার সেই অফিসের চাবি দিয়ে দেয় পুলিশ। এরপরই সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। এবং কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেনের অফিসে হামলা ও ভাংচুর চালায়।