মোঃ মামুন হোসেন: বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস। এ দেশের জন্মই হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনতার রক্তদানের মাধ্যমে। সেই জনগণ, যারা একদিন অস্ত্র হাতে নিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, আজ তারা যেন নিজ দেশেই অসহায়, শোষিত এবং প্রতারিত। কারণ, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে চলে গেছে এক শ্রেণির বেপরোয়া, সুবিধাবাদী ও চাঁদাবাজ নেতার দখলে। এসব নেতৃত্ব জনতার প্রতিনিধিত্ব করে না—বরং তারা জনতার ঘাড়ে জোর করে চেপে বসে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। তাই এখন সময় এসেছে নতুন এক দাবি তোলার—দেশ গড়ার নেতৃত্ব হোক প্রকৃত জনতার হাতে, চাঁদাবাজদের নয়।
বর্তমানে রাজনীতিতে নীতি, আদর্শ কিংবা সেবার জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে ক্ষমতা, দখলদারিত্ব এবং চাঁদাবাজি। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতি পর্যন্ত বিস্তৃত এই অনৈতিক সংস্কৃতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, পরিবহন খাত, এমনকি সরকারি প্রকল্প—সব জায়গাতেই চাঁদার দৌরাত্ম্য। এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে থেকে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই ‘দলবিরোধী’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, কিংবা ‘রাজাকারের দোসর’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়।এই চাঁদাবাজ নেতারা গড়ে ওঠে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। তাদের কাছে কোনো শিক্ষা বা দেশপ্রেমের দরকার হয় না। দরকার শুধু নেতা নামক পৃষ্ঠপোষকের অনুগ্রহ আর দখলদারিত্বের সামর্থ্য। তারা দলীয় সভা-সমাবেশে স্লোগান দেয়, পোস্টার লাগায়, ‘প্যাড’ বানিয়ে চাঁদা তোলে—এভাবেই গড়ে ওঠে এক ধরনের রাজনৈতিক মাফিয়া। এদের দিয়ে সমাজ চলে না, বরং ধ্বংস হয়। শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি—সব কিছুই ভোগে এই দখলবাজদের আগ্রাসনে।জনতার নেতৃত্ব মানে হলো সেই নেতৃত্ব যা জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসে, জনগণের কষ্ট বোঝে, জনগণের স্বার্থে কাজ করে। এই নেতৃত্ব স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং জনসেবায় অঙ্গীকারবদ্ধ। তারা ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব মনে করে রাজনীতি। তারা ঘুষ নেয় না, চাঁদা তোলে না, বরং জনগণের টাকায় জনগণের জন্য পরিকল্পনা করে। তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের একচেটিয়া মুখপাত্র নয়, তারা মানুষের কথা বলে।আমরা যদি এখনই না বদলাই, ভবিষ্যত হবে আরও ভয়াবহ। কারণ, নতুন প্রজন্ম এই নেতিবাচক সংস্কৃতির মাঝেই বেড়ে উঠছে। তারা দেখছে, সৎ হওয়ায় সুযোগ মেলে না, বরং চাঁদাবাজি করে রাতারাতি গাড়ি-বাড়ি বানানো যায়। এভাবে তারা অনুপ্রাণিত হয় না, বরং হতাশ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র তখন কেবল ধ্বংসের দিকে এগোয়।এই পরিবর্তনের সময় এখন। দেশের জনগণ এখন অনেক সচেতন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিকল্প গণমাধ্যম এবং তথ্যপ্রযুক্তি আজ মানুষকে সত্য জানার সুযোগ দিয়েছে। তারা এখন প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে এবং নেতৃত্ব বদলের দাবি জানায়।পরিবর্তনের উপায়-
১. রাজনীতিতে শিক্ষিত ও সৎ লোকদের আগমন নিশ্চিত করা: নেতৃত্বে যেন সেই মানুষরা আসে, যাদের মধ্যে দেশপ্রেম, সততা ও জনসেবার স্পৃহা আছে। দলীয় শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ নিজ দলের ভিতরে চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: কেউ দলীয় পরিচয়ে অপরাধ করে রক্ষা পাবে না—এই বার্তা স্পষ্ট করতে হবে। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ:
শুধু ভোট দেওয়াই নয়, জনগণকে প্রতিদিনের প্রশাসনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নজরদার রাখতে হবে। ভুল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকা: সত্য উদঘাটন এবং চাঁদাবাজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামী, সাহসী ও প্রগতিশীল। তারা কখনোই অন্যায়কে চিরকাল মেনে নেয়নি। আজও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য সৎ মানুষ আছেন যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন, যারা জনতার কষ্ট বোঝেন। দরকার শুধু তাদের সুযোগ দেওয়া। জনগণের শক্তিই পারে এই ভাঙা ব্যবস্থাকে বদলে দিতে, নতুন এক সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।আজ যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদেরও দায়িত্ব আছে আত্মজিজ্ঞাসার—তারা কি সত্যিই জনতার সেবক, নাকি সুবিধাবাদী চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর মুখপাত্র? তারা কি দেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন, না পিছিয়ে দিচ্ছেন?
দেশ গড়ার নেতৃত্ব যেন জনতার হাতে থাকে—এটা কোনো বিলাসিতা নয়, সময়ের দাবি। যারা নেতৃত্বের নামে চাঁদাবাজি করে, সমাজকে ধ্বংস করে, তাদের জায়গা রাজনীতিতে নয়, বিচারের কাঠগড়ায়।এখনই সময়—নতুন বাংলাদেশ গড়ার। যেখানে নেতৃত্ব হবে সৎ, সাহসী ও জনদরদী। যেখানে নেতৃত্ব মানে হবে জনতার প্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রুতি, চাঁদাবাজদের স্বার্থরক্ষা নয়।এগিয়ে আসুন, বলুন—দেশ গড়ার নেতৃত্ব হোক জনতার, চাঁদাবাজদের নয়।