সউদীর আরবের আসির প্রদেশের আবহা এলাকায় ওমরাযাত্রী বহনকারী বাস দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহত ১৩ বাংলাদেশির পরিচয় পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। নিহত ১৩ বাংলাদেশি হলেন, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার শাহীদুল ইসলাম, কুমিল্লার মুরাদনগরের মামুন মিয়া ও রাসেল মোল্লা, নোয়াখালীর মো. হেলাল, লক্ষ্মীপুরের সবুজ হোসাইন, কক্সবাজারের মো. আসিফ ও মোহাম্মদ হোসেন, গাজীপুরের টঙ্গীর মো. ইমাম হোসাইন রনি, চাঁদপুরের রুকু মিয়া, কক্সবাজারের মহেশখালীর সিফাত উল্লাহ, যশোরের মোহাম্মদ নাজমুল ও রনি।
দুর্ঘটনায় আহত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশিরা হচ্ছেন, চট্টগ্রামের সীতাকু-ের সালাহউদ্দিন, ভোলার আল আমিন ও বুরহান উদ্দিন, লক্ষীপুরের মিনহাজ ও রিয়াজ, চাঁদপুরের কচুয়ার জুয়েল, মাগুরার আফ্রিদি মোল্লা ও মিজানুর রহমান, নোয়াখালীর মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, কুমিল্লার ইয়ার হোসাইন ও জাহিদুল ইসলাম এবং যশোরের মোশাররফ হোসাইন। বাসে বাংলাদেশি যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৫ এবং এদের মধ্যে ১৮ জন মারাত্মক আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। এখনও পর্যন্ত ৭-৯ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ রয়েছে। গতকাল বিকেলে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের প্রথম সচিব আরিফুজ্জামানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
রাতে কনস্যুলেটের লেবার কাউন্সেলর কাজী এমদাদুল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ বাংলাদেশি মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় আহত ১৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের লাশ চেনার উপায় নেই। লাশ শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। লাশ শনাক্ত করতে হলে দেশের আত্মীয় স্বজনের রক্ত এনে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া শনাক্তের উপায় নেই। সেক্ষেত্রে আতœীয় স্বজনরা রাজি হলে সউদীতেই মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনের উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি দুর্ঘটনার দু’দিন পর গতকাল বুধবার ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন। এদিকে সউদী আরবে লাশ, বাংলাদেশে চলছে শোকের মাতম।
মুরাদনগর (কুমিল্লা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাওয়ার পথে সউদী আরবের আসির প্রদেশে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এরমধ্যে কুমিল্লার তিনজন নিহত হয়। তারা হলেন, জেলার মুরাদনগরের মামুন, রাসেল মোল্লা ও দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার এলাকার গিয়াস হামিদ। এদিকে নিহতের খবরে কুমিল্লার মুরাদনগরের মোস্তাপুর গ্রামে মামুন মিয়ার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মৃত মামুনের বাবা চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার পোলাডা ১২ দিনের ছুটি পাইয়া চির ছুটিতে চইলা গেল।’
নিহত মামুনের মামী তাসলিমা বেগম জানান, মামুন, তার মামা ইয়ার হোসেন এবং মামুনের ভাগ্নে জাহিদুল ইসলাম বাসে করে ওমরাহ করার জন্য মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। পথে তারা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। মামুন ও স্বজনদের বহন করা বাসটি ব্রেকফেল করে একটি ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা খায়। পরে এতে আগুন ধরে যায়। মামুন গাড়ি থেকে বের হতে পারেননি; আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনায় মামুনের মামা ইয়ার হোসেন ও ভাগ্নে জাহিদ গুরুতর আহত হন। তারা মক্কার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মামুনের বাবা আবদুল আওয়াল জানান, অন্তত ৯ মাস আগে মামুন ভিসার জন্য আবেদন করেন। বয়স কম হওয়ায় সে আবেদন বাদ দেয়া হয়। ৬ মাস আগে ফের আবেদন করেন মামুন। ৫ লাখ টাকা খরচ করে তাকে সউদী আরবে পাঠানো হয়। পুরো টাকা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করা। তিনি বলেন, ‘সউদীতে গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা খবর পাই রাত ১টার দিকে। আমার নাতি জাহিদ ফোন করে বলে নানা, মামুন মামা তো নাই। কলিজাডা ফাইট্টা গেছে কথাডা হইন্না। আমার ছেলের লাশটা আইন্না দাও; আমি দেখমু।’
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলাউদ্দিন ভূঁইয়া জনি বলেন, ‘আমি নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রশাসনিকভাবে পরিবারটির জন্য যা করার দরকার আমরা তাই করব।’ কুমিল্লা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান দফতরের কর্মকর্তা দেব্রবত ঘোষ বলেন, ‘আমরা ঘটনা শুনেছি। লাশ দেশে নিয়ে আসার জন্য যা যা করতে হয়, তার সবই করব।
টঙ্গী (গাজীপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানায়, সউদী আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ইমাম হোসাইন রনির টঙ্গীর বাসায় চলছে শোকের মাতম। বাবা আব্দুল লতিফ ছেলে হারিয়ে অঝোরে কাঁদছেন। ছোট ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা মনে করে তার বড় বোন হাজেরা খাতুন বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
নিহতের ছোট ভাই জানান, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ি। তারা টঙ্গীর বড় দেওড়া এলাকায় বাড়ি করে সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন। রনি দেওড়া এলাকায় টেইলার্স ও মুদি দোকানের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ভাগ্যবদলের আশায় পাড়ি জমান সউদী আরবে।
দুই মাস আগে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ছুটি কাটিয়ে গত শনিবার সউদী আরবের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন। আগামী ১ এপ্রিল তার কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে ওমরাহ পালন করে সবার জন্য দোয়া করার কথা ছিল। সেই আশা আর পূরণ হলো না তার।
নিহতের বাবা আব্দুল লতিফ বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি, আমার ছেলের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। একবারের জন্য হলেও ছেলের লাশটি দেখে যেন শেষ বিদায় জানাতে পারি। এ ঘটনায় টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি শাহ আলম জানান, লাশ আসার পর সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সব কাজ সম্পন্ন করা হবে।
নোয়াখালী জেলা ও সেনবাগ উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সউদী আরবের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শহীদুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহত শহীদুল সেনবাগ উপজেলার ৭ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মোহাম্মদপুর (ভূঁইয়ার দিঘী) মালেক মোল্লার বাড়ির শরিয়ত উল্লাহ প্রকাশ জসিমের ছেলে ও চাটখিল উপজেলার রামনারায়ণপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রামনারায়ণপুর গ্রামের ভূঁইয়াজি বাড়ির হুমায়ন কবিরের ছেলে হেলাল উদ্দিন।
নিহত শহীদুলের পিতা জানান, তার বড় ছেলে রাসেল গত বছর জীবিকার তাগিদে সউদী আরব পাড়ি দেন। সেখানে আবাহ এলাকার মাকান ক্যপেটেরিয়া কোম্পানীর একটি দোকানে কর্মরত ছিলেন।গত সোমবার কোম্পানী থেকে ৩ দিনের ছুটি নিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশি একটি হজ্ব এজেন্সির মাধ্যমে ওমরাহ পালনের উদেশ্যে রওয়ানা দেয়।
তাদের বহনকারী বাসটি সউদী আরবের দক্ষিণাঞ্চলীয় আসির প্রদেশে আকাবা শার এলাকায় পৌঁছলে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিসহ শহীদুলও নিহত হয়। পরিবারের দাবি কোম্পানী নিকট সকল পাওনাসহ যেন তার লাশ দ্রুত সময়ে দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করে।
অপর নিহত হেলালের ছোট ভাই বলেন, গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সউদী আরবের আবহা জেলায় যান হেলাল উদ্দিন। সেখানে একটি কোম্পানীতে চাকরি নেন তিনি। নিজ কর্মস্থল থেকে অপর চার সহকর্মীকে নিয়ে সোমবার দিবাগত রাতে মক্কার উদ্দেশ্যে বাসে যাত্রা করেন তিনি। তাঁর কর্মস্থল থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর বাসটি দুর্ঘটনার শিকার হলে তিনি গুরুত্বর আহত হন। পরে হাসপাতাল নেওয়ার পর মারা যান তিনি।