দেখে মনে হচ্ছিল একই চিত্রের দুই প্রদর্শনী। প্রথম ইনিংসে যে প্রান্ত থেকে সিঙ্গেল নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত, গতকাল ঠিক সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করলেন দ্বিতীয় ইনিংসেও। উদযাপনেও হেরফের হলো না। ড্রেসিং রুমের দিকে একইভাবে ছুটে গিয়ে ব্যাটে চুমু এঁকে ছুড়ে দিলেন। এই বাঁহাতি ব্যাটারের আত্মহারা উদযাপনের এবারের উপলক্ষটা একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রায় ২৩ বছর আর ১৩৮ টেস্ট ম্যচের ইতিহাসে জোড়া সেঞ্চুরির মাত্র দ্বিতীয় নজির গড়েছেন শান্ত। সেই সময় ২২ গজে তাঁর সঙ্গী কে ছিলেন জানেন? এই কীর্তির প্রথম মালিক মুমিনুল হক সৌরভ। এই বাঁহাতি ব্যাটারও এদিন সৌরভ ছড়ানো এক শতকের দেখা পেয়েছেন। তাতেই স্বাগতিক টাইগাররা পেয়েছে ৬৬১ রানের পাহাড়সম লিড। ১৪৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে সব দল মিলিয়েই এর চেয়ে বড় লক্ষ্য দেওয়ার নজির আছে কেবল সাতটি। শান্ত ও মুমিনুলের জোড়া শতকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেটে ৪২৫ রান তোলার পর তা ঘোষণা করে দেয় বাংলাদেশ। বিশাল জয়ের লক্ষ্য ব্যাট করতে নেমে তৃতীয় দিন শেষে আফগানিস্তানের সংগ্রহ ২ উইকেটে ৪৫।
মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে গতকাল ১ উইকেটে ১৩৪ রান নিয়ে বাংলাদেশ দিনের শুরু করে। আগের দিনের মতোই দাপুটে ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন জাকির হোসেন ও শান্ত। আফগানিস্তানের কোনো বোলারই বিপাকে ফেলতে পারেননি এই দুই ব্যাটসম্যানকে। পরে অবশ্য জাকির নিজেই ডেকে আনেন বিপদ। ৭১ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলার পর তিন রানের চেষ্টায় আত্মঘাতী দৌড়ে জাকির হারান নিজের উইকেট। ১৭৩ রানের সেই জুটি ভাঙার পর আরেকটি বড় জুটি গড়ে তোলেন শান্ত ও মুমিনুল। লাঞ্চের আগেই শতকের দেখা পান শান্ত। এর আগে মুমিনুল ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৭৬ রানের ইনিংস খেলার পর, দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ১০৫ রান।
লাঞ্চের পরেই অর্ধশতক পূরণ করেন মুমিনুল। এরপর শেরে বাংলায় এক টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান, বাংলাদেশের হয়ে এক টেস্টে সবচেয়ে বেশি ৩৮টি চার মেরে শেষ পর্যন্ত শান্তর ইনিংস থামে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫১ বলে ১২৪ রান করেন এই বাঁহাতি। এরপর মুশফিকুর রহিম উইকেটে গিয়ে প্রথম বলে নেন দুই রান, পরের বলে ছক্কা মারেন সøগ সুইপে। তৃতীয় বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে হারান উইকেট।
এক ওভারে জোড়া উইকেটের পর আবার আফগান বোলারদের যন্ত্রণাময় সময় দেন মুমিনুল ও লিটন। এই দুজনের জুটিতে রান আসে ওয়ানডের গতিতে। ৯৫ রান নিয়ে চা বিরতিতে গিয়েছিলেন মুমিনুল। বিরতির পরপর ১২ চারে ১২৩ বল খেলে, ১২তম সেঞ্চুরি করেন মুমিনুল। প্রায় ২৬ মাস আর ২৬ ইনিংসের যন্ত্রণাময় অপেক্ষার পর অবশেষে টেস্ট সেঞ্চুরির খরা কেটেছে এই সংস্করণে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১২ সেঞ্চুরিয়ানের। এর আগে চতুর্থ ও পঞ্চম সেঞ্চুরির মাঝে ২৩ ইনিংস অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। যদিও পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন একই ম্যাচে, চট্টগ্রামে! মুমিনুলের শতকের আগেই লিটন ফিফটি করে ফেলেছিলেন ৫৩ বলে। অবশেষে ৬৬১ রানের লিড নিয়ে ইনিংস ছাড়ে বাংলাদেশ। টাইগাররা এর আগে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৪৭৭ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে।
রানের বোঝা মাথেয় নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে ইনিংসের প্রথম বলে উইকেট হারায় আফগানিস্তান। শরিফুল ইসলামের বলে ইব্রাহিম জাদরান পড়েন লেগ বিফোরের ফাঁদে। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি জাদরান। পরের ওভারে আরেক পেসার তাসকিন আহমেদের আঘাত। এবার তার দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে উইকেটরক্ষক লিটনের ক্যাচ পরিণত হন ৫ রান করা আবদুল মালিক।
এরপর ব্যাটিংয়ে নামা আফগান অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ শহীদির চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ ছিল। তবে তাকে ফিরতে হয়েছে আহত হয়ে। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে তাসকিন আহমেদের তৃতীয় বলটি ভেবেছিলেন বাউন্সার হবে। গতি বুঝতে না পেরে আগেই বসে পড়েন শহীদি। কিন্তু সেই বলটি খুব বেশি উঠেনি। সরাসরি গিয়ে আঘাত করে আফগান দলপতির হেলমেটে।
আঘাত পেয়ে মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়েন শহীদি। চেষ্টা করা হয় প্রাথমিক চিকিৎসায় সারিয়ে তুলতে। তবে সফরকারী কাপ্তান উঠে বসার পর আবারও শুয়ে পড়েন। তাই পরে আর ব্যাটিংটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ১৩ রানে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে উঠে গেছেন তিনি। এরপর রহমত শাহ আর নাসির জামাল বাকি সময়টা কাটিয়েছেন বুক ধুঁকপুক নিয়ে। রহমত ১০ আর জামাল ৫ রানে অপরাজিত আছেন। আলোক স্বল্পতায় নির্ধারিত সময়ের একটু আগে তৃতীয় দিনের খেলা বন্ধ করে দেন আম্পায়াররা। এই সময় আফগান দুই ব্যাটারকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। বৃষ্টি বাগড়া না দিলে এই টেস্টে জয় ব্যাতীত অন্যকিছু ভাবছেই না টিম বাংলাদেশ।