পেন্ডুলামের মতো দুলছিল ম্যাচটি। কখনো জয়ের পাল্লা পাকিস্তানের দিকে আবার কখনো ভারতের দিকে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে উপস্থিত প্রায় লাখ খানেক দর্শক তখন দারুণ উৎকণ্ঠায়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ভারতই জিতে নেয়। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। কোহলি-বীরত্বে সেটা তুলে নেয় ভারত। মহারণের শেষ হাসি হাসে টিম ব্লুজ।
৮ বলে দরকার ২৮ রান। ১৯তম ওভারের শেষ দুই বলে কোহলি মেরে দিলেন ২ ছয়! শেষ ওভারের সমীকরণ দাঁড়াল ৬ বলে ১৬ রান।
ম্যাচজুড়ে যত নাটকীয়তা ছিল তার ষোলকলা যেন পূর্ণ হলো এই শেষ ওভারে এসে। এ ওভারে নো আর ওয়াইডসহ ৮ বল করতে হয় নওয়াজকে।
ওভারের প্রথম বলেই ক্যাচ তুলে দেন হার্দিক পান্ডিয়া। এ বল থেকে কোনো রান পায়নি ভারত। ৬ বলে ১৬ রানের সমীকরণ হয়ে যায় ৫ বলে ১৬।
পিচ কাভারের নিয়ম এখন না থাকায় নতুন ব্যাটসম্যান দিনেশ কার্তিককে ফেস করতে হলো ওভারের ২য় বল। এ বলে দিনেশ এক রান নিয়ে কোহলিকে স্ট্রাইক দেন। সমীকরণ দাঁড়ায় ৪ বলে ১৫। তৃতীয় বলে কোহলি নেন দুই রান। সমীকরণ- ৩ বলে ১৩।
শেষ ওভারের এ পর্যন্ত ম্যাচ থাকে পাকিস্তানের হাতেই। ৩ বলে ১৩ রানের সমীকরণ মেলানো বেশ কঠিনও বটে। তবে চূড়ান্ত নাটকীয়তার শুরু এর পরের বল থেকে।
চতুর্থ বলটি হাই ফুলটসে ‘নো’ হয় এবং কোহলি সেটি মেরে দেন ছয়। ফলাফল- বল তিনটিই থেকে গেল, কিন্তু ৭ রান ‘বিনামূল্যে’ পেয়ে গেল ভারত। জিততে হলে রান দরকার আর ৬টি।
পরের বল ওয়াইড করেন নওয়াজ, ৩ বলে ৫ রানে নেমে আসে সমীকরণ। এদিকে নো বলের বদৌলতে পাওয়া ‘ফ্রি হিট’ থেকে যায়।
ফ্রি হিটের বলে (৪র্থ বল) কোহলি বোল্ড হন, কিন্তু বল কিপারকে ফাঁকি দিয়ে ডিপ থার্ডম্যানের দিকে চলে যাওয়ায় দৌড়ে তিন রান নিয়ে নেন দুই ব্যাটসম্যান। সমীকরণ এসে দাঁড়ায় ২ বলে ২ রানে!
নাটক অবশ্য তখনো শেষ হয়নি। ওভারের ৫ম বলে স্টাম্পড হয়ে আউট হয়ে যান দিনেশ কার্তিক। ফলে খেলা গড়ায় একেবারে শেষ বলে।
এক বলে তো যেকোনো ঘটনাই ঘটতে পারে। ১ বা ২ রান যেমন হতে পারে, তেমনি ব্যাটসম্যান আউটও হয়ে যেতে পারেন। কী হবে আসলে, গোটা মেলবোর্ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে অপেক্ষায়।
শেষ বলে ভারতের প্রয়োজন ২ রান। পাকিস্তানের দরকার ডট বা উইকেট। নওয়াজ এর কোনোটাই করলেন না। রানও নিতে দিলেন না উইকেটও নিলেন না। তিনি করে বসলেন ওয়াইড বল। ফলে শেষ বল তখনই আর শেষ হলো না। আরও একবার হাত ঘোরাতে হলো নওয়াজকে।
১ বলে ১ রানের সমীকরণে গিয়ে ঠেকল ম্যাচ।
পাকিস্তান সব ফিল্ডারকে ৩০ গজের বৃত্তে নিয়ে আসল, যাতে সিঙ্গেল না হয়। কিন্তু নওয়াজ বলটা করলেন একেবারেই সাদামাটা। প্রায় ওভারপিচ বলটা অশ্বিন মিড অফের ওপর দিয়ে জাস্ট তুলে দিলেন। লং অফে ফিল্ডার নেই, বল চলে গেল বাউন্ডারিতে!
৪ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় পেয়ে গেল ভারত। ৮২ রানে অপরাজিত কোহলি।
এর আগে, ১৬০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুটা ভালো হয়নি ভারতের। ১০ রানের মধ্যে দুই ওপেনার কেএল রাহুল ও রোহিত শর্মা ফেরেন সাজ ঘরে। ছয় ওভারের মধ্যে আরো এক উইকেট হারায় ভারত। পাওয়ার-প্লেতে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৩১ রান। পাওয়ার-প্লে শেষ হওয়ার পর প্রথম বলেই আরেক উইকেট হারায় ভারত। ফলে ৩১ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে তারা।
পরের গল্পটা কেবল কোহলি আর পান্ডিয়ার। পঞ্চম উইকেট জুটিতে দুজন মিলে গড়েন ১১৩ রানের জুটি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে দুর্দান্ত অর্ধশতক হাঁকান কোহলি (৮২)। তাকে সঙ্গ দেওয়া হার্দিক পান্ডিয়া করেন ৪০ রান। তাদের কীর্তিতেই মহারণে চাপ সামলে দুর্দান্ত জয় তুলে নিল ভারত।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে আসা পাকিস্তানের কাজটা শুরুতে কঠিনই করে তুলেছিলেন আরশদিপ ও ভুবনেশ্বর। দ্বিতীয় ওভারে বাবরকে রানের খাতা খোলার আগেই বিদায় করেন আরশদিপ। ওভারের প্রথম বল ফন্টফুটে খেলতে এসে ইনসুইংগারে পরাস্ত হন পাক অধিনায়ক, বল আঘাত হানে তার সামনের প্যাডে। ভারতের জোরালো আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। ফলে গোল্ডেন ডাক নিয়েই ফিরতে হয় তাকে।
বাবরের ফিরে যাওয়ার পরপর ফেরেন মোহাম্মদ রিজওয়ানও। ১২ বল খেলে তিনি করেন মোটে ৪ রান। বাবর আর রিজওয়ান টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করতে নেমেছেন, এমন ম্যাচে কখনো দুজনের সামষ্টিক এর চেয়ে কম হয়নি। মহারণে দুই অভিজ্ঞ ব্যাটারকে হারিয়ে শুরুতেই চাপে পড়ে যায় পাকিস্তান।
সেই চাপ সামলে পাকিস্তানকে এরপর পথ দেখাতে থাকেন ইফতিখার আহমেদ এবং শান মাসুদ। শুরুতে খোলসে ঢুকে থাকলেও ১০ ওভার পেরোতেই হাত খোলেন ইফতিখার। অক্ষর প্যাটেলের এক ওভারে তিন ছয়ে ইফতিখার রান তোলেন ২১, ছুঁয়ে ফেলেন ব্যক্তিগত ফিফটিও। এরপরই অবশ্য ফিরে গেছেন তিনি। পাক শিবিরে ছোট একটা ধস নামে তার বিদায়ের পর।
মোহাম্মদ নওয়াজ, শাদাব খান, হায়দার আলি, এবং আসিফ আলি দ্রুত আউট হলে আবারো চাপে পড়ে পাকিস্তান। শান মাসুদ অবশ্য একপাশ আগলে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অর্ধশতকও পূরণ করে ফেলেন। তবে এরপরও পাকিস্তানের ১৬০ রানের লক্ষ্য পূরণটা সম্ভব মনে হচ্ছিল না, যেটা শেষমেশ সম্ভব হলো শেষদিকে শাহিন আফ্রিদির ক্যামিওতে। শেষ দিকে তার ৮ বলে ১৬ রানের ইনিংসে পাকিস্তান শেষমেশ ১৫৯ রান তুলে ২০ ওভার শেষ করে। যে পুঁজিতে ভারতকে চাপে ফেলতে পারলেও শেষ রক্ষাটা হয়নি পাকিস্তানের।