বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের ভূখ- থেকে চলে গেছে। সংস্থাটির পরিচালক আজিজুর রহমান গতকাল রোববার রাত ৮টায় বলেছেন, ‘এটা আমাদের দেশ থেকে পুরোপুরি চলে গেছে। আমাদের ভূখ-ে এটার আর কোন অস্তিত্ব নেই। এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে এবং গাছপালা উপড়ে পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা মো. আজিজ গতকাল বিকালে টেলিফোনে বলেছেন, পুরো দ্বীপে ল-ভ- অবস্থা। টিনের, বাশের হালকা ঘরবাড়িগুলো উড়ে গেছে। টিন, কাঠ, বাঁশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জায়গায় জায়গায় নারকেল গাছ, বিভিন্ন ধরনের গাছ উপড়ে পড়ে আছে। জেটির কাছে যে হোটেল-রেস্তোরাগুলো ছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে বলে জানান তিনি। এখনো দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখায় কক্সবাজার জেলায় প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিধ্বস্ত হয়েছে ১২০০ বাড়িঘর। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা যেখানে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিত্তেওয়ে শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
সেখানকার একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, সেখানকার কাঠের বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। এমনকি শক্ত অনেক বাড়ির ছাদ উড়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সিত্তেওয়ে শহরের কেউ এখনো বাইরে যেতে পারছে না। সেখানে কোন রকম উদ্ধার তৎপরতাও নেই। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিরোধী এনইউজে সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঝড়ে ইরাবতী এবং মান্দালায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কমে যাওয়ায় কক্সবাজারের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে মানুষজন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।
ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে : ‘কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরের ওপর ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত নামিয়ে তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। ‘ঝড়টা আর নেই, মানুষজন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে,’ বলছেন আজিজুর রহমান। তবে ঝড় চলে গেলেও সেটার প্রভাবে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি থাকবে বলে তিনি জানান। সেই সঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সমুদ্র উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে আপাতত সমুদ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। কাল মঙ্গলবার নাগাদ সব ধরনের সতর্ক সঙ্কেত নামিয়ে আনা হবে বলে তিনি আশা করছেন।
টেকনাফ থেকে আমাদের সংবাদদাতা মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান জানান, কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন ও উপকূল এলাকাসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আঘাতে ঘরবাড়ি স্কুল মাদরাসাসহ প্রায় তিন শতাধিক ঘড়বাড়ি ভেঙে পড়ছে। এছাড়া পানের বরজ, ফসলি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ভেঙে পড়েছে গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুটি। তবে সেন্টমার্টিনসহ উপকূল এলাকায় ঘুর্ণিঝড় মোখার প্রভাব কমে হালকা, হালকা বাতাস হচ্ছে। গতকাল রোববার দুপুর ১টার দিকে সেন্টমার্টিন-টেকনাফসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মোখা তা-ব চালায়। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানা গেছে।
সেন্টমার্টিন বাসিন্দা বীচ কর্মী জয়নাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা’র ভয়াবহতায় আমাদের ঘরবাড়ি টিন উড়ে গেছে, গাছপালা পড়ে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমরা ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছি। বাহারছড়া উপকূল ইউনিয়ন মো. জুবায়ের ইসলাম জুয়েল বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা দ্রুতগতিতে আমাদের ওপর দিয়ে চলে গেলেও আল্লাহর রহমতে আমরা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছি। তবে আমাদের এখানে রাস্তায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে, বাড়িতে গাছ পড়ছে, বৈদ্যুতিক খুটি ভেঙে পড়ছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি নুরুল আমিন বলেন, বাতাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে ক্যাম্পের বসতির ওপরের ছাউনি উপড়ে পড়ছে। পরিবারে লোকজনদেরকে আমরা নিরাপদে সরিয়ে রাখার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির থেকে রক্ষা পেয়েছি।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা’র কারণে রাস্তা ঘাটে ভেঙে পড়ছে গাছপালা, শতাধিকের উপরে ঘরবাড়িসহ স্কুল-মাদরাসা ভেঙে পড়ছে। এখন ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব কমে গেছে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। যারা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তাদের সহযোগিতা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ হয়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা মিয়ানমারের দিকে অতিক্রম করে গেছে। সেন্টমার্টিন-টেকনাফ ও রোহিঙ্গাসহ উপকূলে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, পাশাপাশি রাস্তায় গাছপালাসহ বৈদ্যুতিক খুটি পড়ছে। আমরা সব খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সেন্টমার্টিনের আশ্রয়কেন্দ্রে সারাদিনে খাবার শুধু এক পিস কেক : সেন্টমার্টিনের হাসপাতালে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ মানুষ। ঘূর্ণিঝড় মোখার আতঙ্কের পাশাপাশি তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ক্ষুধার যন্ত্রণাকেও। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের অভিযোগ, গতকাল সকালে কেবল এক পিস কেক দেওয়া হয়েছিল তাদের। এরপর আর কোনো খাবার পাননি তারা।
পর্যটন ব্যবসায়ী তকি উসমানি গতকাল রোববার বিকাল ৪টার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রটি থেকে বলেন, ‘সকালে এক পিস কেক দিয়েছিল। সেন্টমার্টিনের আশ্রয়কেন্দ্রে সারাদিনে খাবার দিয়েছে শুধু ওই এক পিস কেক। এরপর আর কোনো খাবার নেই। রান্নাও করা হয়নি।’ তকি উসমানি বলেন, ‘আমরা সেন্টমার্টিন হাসপাতালে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রের তিন তলায় আছি। এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ মানুষ। প্রচ- বাতাস, অনেক গাছপালা ভেঙে গেছে। অল্প কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এসে উঠেননি।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‹এখনো ঝড় হচ্ছে, প্রচ- বাতাস বইছে। তবে, সেন্টমার্টিনে অবস্থানরত মানুষ নিরাপদে আছেন। আমরা সেখান থেকে বেশ কিছু ভিডিও পেয়েছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে গাছপালা ভেঙে যাচ্ছে। ঝড় থামলে তারপর আমরা নিরূপণ করতে পারব যে কি পরিমাণ গাছ ভেঙেছে এবং কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।›
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার দেওয়া গেল না কেন জানতে চাইলে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা অবস্থান করে সার্বিক বিষয় দেখভাল করছেন। এখন আশ্রয়কেন্দ্রসহ পুরো সেন্টমার্টিনের যে পরিস্থিতি তাতে রান্না করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা শুকনো খাবার দিয়ে এখনকার সময়টা পার করার চেষ্টা করছি। খাবারের সব ব্যবস্থা করা আছে। ঝড় কমলে রান্নার ব্যবস্থা হবে।’ পরিস্থিতি জানতে সেখানে অবস্থানরত সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যানের নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।