বাংলাদেশের জন্য আবারও বন্ধ হয়ে গেল বৈদেশিক কর্মসংস্থানের চতুর্থ বৃহত্তম মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় শেষ হবে শুক্রবার মধ্যরাতে।
১ জুন থেকে আর কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক দেশটিতে যেতে পারবে না। তবে পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে শ্রমবাজার আবারও খুলে দিতে পারে দেশটি।
এখন পর্যন্ত যারা দেশটিতে পৌঁছেছেন তাদের অনেকেই এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছেন। এই মুহূর্তে এয়ারপোর্টের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। এ অবস্থায় এয়ারপোর্টের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি রাখছে কর্তৃপক্ষ।
মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে শুক্রবারের পর বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ থেকে কোনো কর্মীকে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।
গত জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ এ সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি পুনরায় করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখিস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কর্মী যায় মালয়েশিয়ায়।
মালয়েশিয়ার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নর্থ-সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক আদ্রিয়ান পেরেইরা বলেন, সরকার একটি কসমেটিক সমাধান দিয়েছে যা মূল সমস্যার সমাধান করবে না। দুর্নীতি, ভেঙে যাওয়া নিয়োগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধী স্বার্থ পর্যন্ত এসব সমস্যার মূলে রয়েছে।
২৮ মে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া এসেছেন মো. সাব্বির আহমেদ (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ৩০ হাজার টাকার একমুখী টিকিট ১ লাখ ৮ হাজার টাকা দিয়ে কেটে এখানে এসেছি। অনেক বাংলাদেশি উল্টোপথে মানে দুবাই, কাতার, চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া হয়ে কুয়ালালামপুরে ঢুকেছে। ফলে এখানকার এয়ারপোর্টেও অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি প্রায় সাত ঘণ্টা এয়ারপোর্ট অপেক্ষা করার পর নিয়োগকর্তাকে খুঁজে পাই।
ঢাকার অভিজ্ঞতা একই রকম ছিল বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান বলেন, অতিরিক্ত প্রায় ২০টি ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী মালয়েশিয়ায় আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা মালয়েশিয়ায় আসার কাগজপত্র পেয়েছেন, তাদের বড় অংশ পৌঁছেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার শামীম আহসান বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হচ্ছে না। নানা কারণে তারা তাদের পলিসিগুলো পুনর্বিবেচনা করছে। আমাদের ধারণা, এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই তারা নতুন করে কর্মী নেবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত চার লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র নিয়েছেন। এদের বেশিরভাগ পৌঁছে গেছেন।
মালয়েশিয়া প্রবাসী আমীর হোসেন বলেন, মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ হলে সেটার বড় প্রভাব বাংলাদেশের শ্রম বাজারে পড়বে। বছরে অন্তত এক লাখ কর্মী অভিবাসন কমে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশীয় শ্রমবাজারেও দেখা যাবে।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, শুধু ২০২৩ সালেই সাড়ে তিন লাখের বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া।
সম্প্রতি, মালয়েশিয়া ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট শ্রমিকের ১৫ শতাংশ বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার।
অভিবাসন বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ২০ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন।
সম্প্রতি কর্মীদের মানবাধিকার নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমালোচনার মুখে পড়েছে মালয়েশিয়া। গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের কাছে এক চিঠিতে তারা বলেন, বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অপরাধী চক্রগুলো সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রগুলো প্রতারণার মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ভুয়া কোম্পানিতে শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ঋণের চক্রে আটকে পড়েন।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষের সঙ্গে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন পর্যন্ত জড়িত।
শ্রমিকদের ব্যাপক শোষণের অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশকে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস জেনেভায় মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি নাদজিরাহ ওসমানের একটি চিঠি আপলোড করেছে।
গত ২৮ মে লেখা ওই চিঠিতে তিনি সরকারের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, মালয়েশিয়া অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে এবং অপরাধমূলক নেটওয়ার্কের বিরোধিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।