মানিকগঞ্জ-২ আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম পরাজিত হয়েছেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করে প্রথমবারের মতো জয় নিশ্চিত করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু। এ নিয়ে জেলায় চলছে আলোচনা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, নিজ দলের নেতাকর্মী, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় মমতাজের এই পরাজয়। এছাড়া, এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ভোটের মাঠে প্রভাব পড়েছে।
সিঙ্গাইর, হরিরামপুর এবং মানিকগঞ্জ সদরের তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-২ সংসদীয় আসন। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৯ জন। এর মধ্যে দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু পেয়েছেন ৮৮ হাজার ৩০৯ ভোট। আর মমতাজ বেগম পেয়েছেন ৮২ হাজার ১৩৮ ভোট। দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু ৬ হাজার ১৭১ ভোট বেশি পেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে জয়ী হন। দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ না থাকা দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু বছর দেড়েক আগে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তিনি।
সিঙ্গাইর উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছর পাঁচেক আগে চাচাতো ভাই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুলের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু। তখনও তাঁর রাজনীতির সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কী কারণে তিনি মমতাজ বেগমের মতো তিনবারের সংসদ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাচিত হলেন?
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালে মমতাজ বেগম আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব নেতাকর্মীদের ভালো সম্পর্ক ছিল। কেন্দ্রীয় প্রতিটি কর্মসূচিতে মমতাজ বেগম দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পালন করতেন। গত উপজেলা নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সায়েদুল ইসলাম নৌকার মনোনয়ন চেয়েও তা পাননি। কিন্তু মমতাজ বেগমের ভাগ্নে মনোনয়ন পাওয়ায় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরপর সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কেন্দ্র থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ খানকে সভাপতি না করে মমতাজ বেগম নিজে সভাপতি এবং তাঁর ভাগ্নে শহিদুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করেন। এতে মমতাজের সঙ্গে মাজেদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে মাজেদ খান এবং সায়েদুল ইসলাম এক হয়ে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে মমতাজের কাছ থেকে বের হয়ে যান। তারা বিভিন্নস্থানে আয়োজিত কর্মসূচিতে মমতাজের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং সিঙ্গাইর উপজেলায় উন্নয়ন না হওয়ার কথা বলতে থাকেন। এতে নির্বাচনি এলাকায় মমতাজ বেগমের ইমেজ নষ্ট হতে থাকে। যার প্রভাব এবারের নিবার্চনি ফলাফলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
নির্বাচনে মমতাজ বেগম কেন হারলেন– এমন প্রশ্নে সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান বলেন, ‘এক বছর আগে জেলা পরিষদ নির্বাচনে আমরা মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে নৌকার পক্ষে কাজ করতে থাকি। অপরদিকে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মাজেদ খান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সায়েদুল ইসলাম গোপনে ‘চশমা’ প্রতীকের প্রার্থী বজলুল হক খান রিপনের পক্ষে কাজ করেন। এ নিয়ে নির্বাচনের দিন উপজেলা পরিষদ চত্বরে সায়েদুল হকের সঙ্গে আমার উত্তপ্ত বাকবিতন্ডা হয়। এরই জেরে বছর খানেক আগে হঠাৎ রাজনীতিতে উদয় হওয়া টুলুকে এমপি বানানোর লোভ দেখিয়ে তাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে আব্দুল মাজেদ খান এবং সায়েদুল ইসলাম নিবার্চনের আগে মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে নানা ধরণের মিথ্যা অপপ্রচার চালাতে থাকেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন নিবার্চনে প্রার্থী হওয়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল এবং সিঙ্গাইর উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান খান হান্নান। নির্বাচনের আগে এদেরকে গোপনে সহযোগিতা করেন মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দিন এবং হরিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তারা মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অপপ্রচার, আওয়ামী লীগের উন্নয়ন বিরোধী কথা বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। একই সঙ্গে কালো টাকার ব্যবহার করায় নিবার্চনি ফলাফল মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে চলে যায়।’
এ বিষয়ে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ টুলু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে সারা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও ঢাকার সবচেয়ে কাছের উপজেলা সিঙ্গাইর এবং হরিরামপুর উপজেলায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার (মমতাজ) সময়ে সিঙ্গাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের যেসব কমিটি হয়েছে তা পারিবারিক কমিটি হয়েছে। এখানে সংসদ সদস্য মমতাজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তারই ভাগ্নে শহিদুর রহমান। উপজেলা আওয়ামী লীগ জিম্মি হয়ে গেছে। এ কারণে সিঙ্গাইর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকসহ উপজেলার ১১ জন ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে ৯ জন মমতাজের সঙ্গ ত্যাগ করে আমার কাছে আসেন। তারা আমার পক্ষে নির্বাচনে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করায় আমি জয়ী হতে পেরেছি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, ‘এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। তিনটি আসনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে আমাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট নিশ্চিত করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিনি (মমতাজ) সংসদ সদস্য থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ বদনাম হয়েছে। নিবার্চনে ভোটারদের আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া, সিনিয়র নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার (মমতাজ) সুসম্পর্ক না থাকায় নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছি।’