শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে জনরোষের মুখে পালালেও বিক্ষোভ থামেনি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে তুষ্ট নয় বিক্ষোভকারীরা। তাদের নজর এবার প্রেসিডেন্টের গদিতে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেরও পদত্যাগ চায় তারা। বুধবার সংকটগ্রস্ত শ্রীলংকার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে বিক্ষোভকারীরা।
এর আগে মঙ্গলবার রাতভর দেশটির অর্ধশতাধিক এমপি-রাজনীতিকের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ লোকজন। বিক্ষোভ দমনে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট ও জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী যে কাউকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গুজব রটেছে, মাহিন্দা রাজাপাকসেসহ অনেক নেতা ভারতে পালিয়েছেন। তবে গুলির নির্দেশের খবর অস্বীকার করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল গুনারত্নে বলেছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে মাহিন্দা রাজাপাকসে নৌঘাঁটিতে রয়েছেন। এদিকে সোমবারের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৮ জন হয়েছে। খবর বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, এনডিটিভিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের।
শ্রীলংকার পুলিশ বলছে, মঙ্গলবার রাতেও অর্ধশতাধিক এমপি-রাজনীতিবিদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এছাড়া আরও অন্তত ৭৫টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে বেশ কিছু বেসরকারি সম্পত্তিও বিক্ষোভকারীদের হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বেছে বেছে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বাড়ি-গাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ক্ষুব্ধ মানুষ। অনেকের ওপর শারীরিক হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
ক্ষমতাসীন দল শ্রীলংকা পোদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) সংসদ সদস্য সনাথ নিশান্ত, জনক থিসা কুট্টিয়ারচ্চি, রোহিতা আবেগুনাবর্ধনে, আনুশা পাসকুয়াল, প্রসন্ন রানাতুঙ্গা, রমেশ পাথিরানা, শান্ত বান্দারা, কনাকা হেরাথ, অরুন্দিকা ফার্নান্দো, গামিনী লোকুগে, শেহান সেমাসিংহ, মহিপাল হেরাথ, প্রসন্ন রানাতুঙ্গা, ট্রেভিন ফার্নান্দো, বান্দুলা গুনবর্ধনে, রেণুকা পেরেরা, কেহেলিয়া রামবুকওয়েলা, কাঞ্চনা বিজেসেকারা, সিরিপাল গামলাথ, রোশন রানাসিংহ, নালাকা গোদাহেওয়া, ডুমিন্ডা দিসানায়েক ও আলী সাবরি রহিমের বাসভবনে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
এছাড়া এসএলপিপির আরেক এমপি জনস্টন ফার্নান্দোর মালিকানাধীন দুটি বাড়ি, একটি কারখানা ও একটি মদের দোকানে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। সরকারদলীয় এমপি নিমল লাঞ্জার বাড়ির পাশাপাশি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা চালানো হয়েছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে কুরুনেগালার মেয়র থুশারা সঞ্জিওয়া এবং মোরাতুয়ার মেয়র সমন লালের বাসভবনে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘গোটা গো গামা’ বিক্ষোভস্থলে আন্দোলনকারীরা। সেখানে তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান নেওয়া বিক্ষোভকারীদের একজন লাহিরু ফেরনানডো বলেন, এখন পুরো দেশ আমাদের সমর্থন দিচ্ছে। আমরা অনতিবিলম্বে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার পদত্যাগ এবং নতুন সরকার চাই।
এর আগে সোমবার ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বোয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের শিবিরে হামলা করলে জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এতে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আটজন নিহত ও ২০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে সহিংসতা বন্ধ করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে এক টুইটে বলেছেন, সাংবিধানের ভিত্তিতে ঐকমত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সব ধরনের চেষ্টা করা হবে।
ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা দুমিন্দা নাগামুয়া দাবি করেন, শ্রীলংকার সশস্ত্র বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে সে অভিযোগ নাকচ করে দেন প্রতিরক্ষাপ্রধান ও সেনা কমান্ডার জেনারেল শাভেন্দ্র সিলভা। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের লজ্জাকর কর্মকাণ্ডে জড়াবে না।
স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকছে শ্রীলংকা। বিদেশি মুদ্রার মারাত্মক ঘাটতির কারণে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিও বন্ধ হয়ে আছে। কয়েক মাস ধরে দেশটির বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে মূলত প্রতিবেশী ভারত, তারা তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ দেশটিকে এ পর্যন্ত সাড়ে তিনশ কোটি ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্যাকেজের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে দেশটি এবং চীনের কাছেও সাহায্য চেয়েছে।
স্পিকারের বিশেষ সভা : চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে বিশেষ দলগুলোর নেতাদের নিয়ে একটি বিশেষ সভা করেছেন শ্রীলংকার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সভায় কী নিয়ে আলোচনা হয় সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে এ সভা করেন স্পিকার।
সেনা মোতায়েন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ : শ্রীলংকায় সেনা মোতায়েন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে রাজধানী কলম্বোয় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, শ্রীলংকায় সেনা মোতায়েন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে হোক কিংবা বেসামরিক কোনো শাখার মাধ্যমেই হোক, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর কখনোই সহিংসতা ও তাদের হুমকি দেওয়া উচিত নয়।
নৌঘাঁটিতে আছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে : হেলিকপ্টারে পরিবার নিয়ে পালানোর পর শ্রীলংকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে কোথায় আছেন এ নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা। গুজব রটেছে, তিনি ভারতে পালিয়েছেন। তবে মাহিন্দার ছেলে নামাল রাজাপাকসে বলেছেন, তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি।
নামাল এএফপিকে বলেন, বাবা এবং আমাদের দেশ ছেড়ে পালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নৌঘাঁটিতে আছেন মাহিন্দা। মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল গুনারত্নে বলেছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে মাহিন্দা রাজাপাকসে নৌঘাঁটিতে রয়েছেন।