‘আমাকে আমাদের না-জন্মানো শিশুটি ফেলে দিতে হবে, এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত,’ এভাবেই বলছিলেন ২৭ বছর বয়সী গৃহসজ্জা ডিজাইনার মিতরা। যিনি তার পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে বাস করেন।
মিতরা এবং ৩২ বছর বয়সী চিকিৎসক মোহসেন একসাথে থাকেন। বিয়ে ছাড়াই এভাবে একসঙ্গে থাকাকে ইরানে বলা হয় ‘হোয়াইট ম্যারেজ’ বা সাদা বিয়ে।
ইরানি সমাজের কড়া ইসলামি আইনে নারী-পুরুষের এভাবে একসাথে থাকা; বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কের মতই অবৈধ। কিন্তু তারপরও দেশটিতে এই সাদা বিয়ে চলছে।
মিতরা বলেন, মোহসেন এবং আমি আগে থেকেই এই চ্যালেঞ্জগুলো আগেই বুঝেছিলাম। কিন্তু তখন আমাদের সন্তান নেওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা মত পাল্টালেন। তাদের আশা ছিল, ইরানের আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কোন-না-কোনভাবে তারা অনাগত শিশুটির একটি বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র পেয়ে যাবেন।
কিন্তু তাদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি তাদেরকে গর্ভপাতের দিকেই ঠেলে দিল।
শ্বেত-বিবাহ বাড়ছে ইরানে
বেশ কয়েক বছর আগে বিবিসির ফারসি বিভাগের রানা রহিমপুর এক রিপোর্টে লিখেছিলেন, ইরানে এই শ্বেত বিবাহের প্রচলন এতটাই বেড়ে গেছে যে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতি দিয়ে এ ব্যাপারে তার ‘গভীর আপত্তি’ প্রকাশ করেছিলেন।
তার কার্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ মোহাম্মদী গোলপেগানির এক বিবৃতিতে কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল ‘কোহ্যাবিটেশন’ বা বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন কোন দয়া প্রদর্শন করা না হয়।’
এতে বলা হয়েছিল, ‘পুরুষ ও নারীর বিয়ে না করে একসাথে থাকা লজ্জাজনক। যেসব লোকেরা এ জীবন বেছে নিয়েছে তাদের একটি বৈধ প্রজন্মকে অবৈধ প্রজন্ম দিয়ে মুছে দিতে বেশি সময় লাগবে না।’
কিন্তু এসব সতর্কবাণী ইরানের তরুণ প্রজন্ম শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। এ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ইরানে কোন যুবক-যুবতী সাদা বিয়ে করবে এমনটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন এরকম অবিবাহিত দম্পতির সংখ্যা বাড়ছেই।
ইরানি নাীদের মধ্যে জনপ্রিয় সাময়িকী ‘জানান’ ২০১৪ সালে এ বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। তবে এর কয়েক মাস পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে কর্তৃপক্ষ ‘বিয়ে না করে একসাথে থাকাকে উৎসাহিত করার’ অভিযোগে ম্যাগাজিনটি নিষিদ্ধ করে।
এ ব্যাপারে ঠিক কি করা যায়; তা নিয়ে ইরানি কর্তৃপক্ষ দ্বিধায় আছে বলে মনে হয়। ইরানের যুব বিষয়ক উপমন্ত্রী মোহাম্মদ মেহদি তন্দগোইয়ান সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইরনাকে বলেছেন, অবিবাহিত যুগলদের সন্তানদের একসময় তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দরকার হবে; যখন তারা স্কুলে ভর্তি হতে যাবে।
বিয়ে এবং বিচ্ছেদ, দুটিই ব্যয়বহুল
ইরানে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায়ই ব্যয়বহুল হয়, আর এর খরচ দিতে হয় বরের পরিবারকে। আর বিয়ে ভেঙে গেলে স্ত্রীকে ‘মাহরিয়েহ’ হিসেবে যে অর্থ দিতে হয়- তাও দিতে হয় স্বামীকে।
এর অংক হয় বেশ বড়, আর তা না দিতে পারলে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাদা বিয়ে নিয়ে বিবিসির রানা রহিমপুরের রিপোর্টে কথা বলেছিলেন তেহরানের বাসিন্দা আলি ও তার বান্ধবী। যারা তখনকারও দু’বছর আগে থেকেই একসাথে থাকছেন। বিয়ে করার খরচ অনেক, আর ডিভোর্স পাওয়ার খরচ আরো বেশি— বলেন আলি।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই মনে করেন, ইরানে অনেক যুগলই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে চায় না। এর কারণ হচ্ছে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের হার।
ইরানের একজন সমাজকল্যাণ সংস্থার একাংশের পরিচালক ফারহাদ আঘতার বলছেন, ইরানে প্রতি পাঁচটি বিয়ের একটি বিবাহবিচ্ছেদ হয়। সারা ইরানের মধ্যে রাজধানী তেহরানে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি।
দেশটির সমাজবিজ্ঞানী মেহেরদাদ দারভিশপুর; যিনি এখন সুইডেনে থাকেন— বলছিলেন, ‘এটা বলতেই হবে যে ইরানের সমাজের অধিকতর ধার্মিক অংশ বিয়ে ছাড়া নারীপুরুষের একসাথে থাকা গ্রহণ করে না।’
বাড়ি ভাড়া নেওয়া মুশকিল
ইরানের আইনে বিয়ের বাইরে কোন নারী-পুরুষের শারীরিক সংস্পর্শ ঘটলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ; যার জন্য ৯৯টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তির বিধান রয়েছে। এ কারণে যে যুগলরা এরকম সাদা বিয়ে করেছেন— তারা এটা নানাভাবে গোপন রাখেন যাতে লোকের চোখে তা ধরা না পড়ে।
দেশটির আরাক শহরে তার ছেলেবন্ধুকে নিয়ে বসবাস করেছেন মারজান। তিনি বলছেন, তাকে চার বার বাসা বদল করতে হয়েছে— কারণ বাড়িওয়ালা জেনে গিয়েছিল যে তিনি এবং তার ছেলেবন্ধু বিবাহিত নন।
‘তারা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতো তোমরা কবে বিয়ে করবে, কবে আংটি কিনবে? তখন আমি ভাবলাম ওরা আমার ওপর নজর রাখছে—এখন আমাকে নতুন বাসা দেখতে হবে।’
ইরানের আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী মেহরাঙ্গিজ কারের কথায়, ‘একটা বড় সমস্যা হলো, বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকাটা যেহেতু বেআইনি—তাই কোন সমস্যা হলে এসব যুগলদের আইনি সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ নেই।’
আমরা নতি স্বীকার করবো না
ইরানের এলিট সমাজ এসব সাদা বিয়ের ফলে জন্ম নেয়া শিশুদের সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু তারা এ বিষয়টা নিয়ে খুব কমই প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।
দেশটির একজন স্পষ্টভাষী এবং সংস্কারপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য হচ্ছেন পারবানেহ সালাহশুরি। তিনি গত সেপ্টেম্বর মাসে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, যে নারীরা বিয়ে না করে একসাথে আছেন। তারা গর্ভবতী হলে তাদের সামনে গর্ভপাত ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
কিন্তু সালাহশুরির এই মন্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ বলে আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করে অতিরক্ষণশীল ফারস নিউজ এজেন্সি। ইরানের এস্টাব্লিশমেন্ট যুক্তি দিচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বিয়ের আগেকার নানা রকম জটিল সামাজিক রীতিনীতির কারণে অবিবাহিত ইরানিরা এখন সনাতনী ধর্ম-অনুমোদিত বিয়ে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
ইরানের তরুণ প্রজন্মকে বিয়েতে উৎসাহিত করতে চালু হয়েছে হামদানের মত ডেটিং এ্যাপ। বিয়ের প্রাথমিক খরচ মেটাতে সুদমুক্ত ঋণও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হামেদানের বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সী শিনা একে ‘পেইন কিলার’ বা ব্যথানাশকের সাথে তুলনা করছেন।
তিনি বলেন, ‘বাড়ি ভাড়া দিতে দিতে যে আমার ঘাড় ভেঙে যাচ্ছে – তার কি হবে?’ শিনা এক দশক ধরে তার সঙ্গী সাদেকের সাথে বসবাস করছেন। তিনি মনে করেন, এভাবে একসাথে থাকাটা হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ।
আলোচনা সামাজিক মাধ্যমে
ইরানের সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো খুবই প্রাণবন্ত এবং সেখানে বিয়ে-ছাড়া একসঙ্গে থাকার জনপ্রিয়তা খুবই স্পষ্ট। এতে আরো বোঝা যায়, এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে অনেকগুলো চ্যানেল আছে যেখানে ‘সিঙ্গেল’ ইরানিরা তাদের সঙ্গী খুঁজে নেন।
একটি চ্যানেল আছে যার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৪৫ হাজারেরও বেশি। এগুলোতে একজন সঙ্গী পাওয়ার আশায় ইরানিরা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেন। কিন্তু ইরানের কট্টরপন্থীদের মধ্যে এর বিরোধিতার কারণে এসব ভার্চুয়াল কমিউনিটির ভাগ্য অনিশ্চয়তার সূতোয় ঝুলছে।
এ বছরই ইরানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেশটিতে ক্ষমতার ওপর রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণ জোরালো হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেই তিনি ইরানের ইন্টারনেটের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থাকে সাইবারস্পেসে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় আগামীতে হয়তো নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করা হতে পারে।
‘আমাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে’
শিনা ও সাদেককে বর্তমান বিধিনিষেধের জন্য উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। ২০১৬ সালে শিনা গর্ভবতী হলে তারা দু’জন জার্মানিতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করেন। কারণ তারা জানতেন যে তাদের সন্তানকে কি ধরনের আইনী সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু তাদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ‘আমাদের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল, গর্ভপাত ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না’, বলছেন শিনা।
ইরানের দেওয়ানি আইনের ১১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, ব্যভিচারের ফলে জন্মানো শিশু ব্যভিচারকারীর হতে পারবে না। এর অর্থ হচ্ছে, সন্তানের পিতামাতা অবিবাহিত হলে তাদের দম্পতি হিসেবে সন্তানকে রাখার কোন অধিকার থাকবে না এবং জন্ম নিবন্ধনের সনদে শুধুমাত্র শিশুটির মা তার নাম লিপিবদ্ধ করার অনুরোধ করতে পারবেন।
ইরানের কর্তৃপক্ষ এভাবে জন্মানো শিশুদের একটি গোপন রেকর্ড রাখে এবং এসব তথ্য ভবিষ্যতে তাদের কিছু কিছু চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে দেশটিতে অবিবাহিত যুগলের সংখ্যা কত; তার কোন সরকারি পরিসংখ্যান নেই।
গর্ভপাত বা দেশত্যাগ
একজন ৩৬ বছর বয়সী চিকিৎসকের সাথে কথা হয়; যিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে তার নাম প্রকাশ করতে চাননি। রাজধানী তেহরানের পশ্চিম প্রান্তে তার প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। তিনি বলছেন, তিনি বিয়ে না করে একসাথে বসবাসরত যুগলদের জন্য তিনটি অবৈধ গর্ভপাত করিয়েছেন।
অন্যদিকে যে যুগলদের হাতে অর্থ আছে; তাদের জন্য একটা বিকল্প হলো ইরান ছেড়ে অন্য কোন দেশে চলে যাওয়া। পারি এবং তার সঙ্গী ইয়াসিন; দু’জনের বয়স ৩৫ বছর। তারা তাদের সঞ্চিত সব অর্থ দিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন।
ইরানের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং শ্বাসরুদ্ধকর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে অনেক ইরানির কাছেই একটি জনপ্রিয় বিকল্প হয়ে উঠেছে তুরস্ক। পারি নিজেও একবার গর্ভপাত করিয়েছেন। এখন তিনি আবার সন্তান-সম্ভবা। তবে এবার তিনি গর্ভপাত করাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন।
‘যেদিন প্রথম আবার সকালবেলা শরীর খারাপ লাগলো, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ সন্তান আমি রাখবোই—যে মূল্যই দিতে হোক না কেন,’ বলছিলেন পারি। ‘কিন্তু আমি আমার অন্য বন্ধুদের কথা ভুলতে পারছি না—যারা বিয়ে না করে একসাথে আছে, যারা সন্তান চায়—কিন্তু নিতে পারছে না।’