এটা এমনই একটা সাধারণ দিন ছিল, যেখানে সাকিব আল হাসান নিজেও সাফল্য উদযাপন করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ। শরীর জুড়ে অবসন্নতা।
বিশ্বকাপে অভিষিক্ত মাহেদী হাসানের হাওয়ায় ভাসানো স্লোয়ার বলে লং অনে ক্যাচ দিয়েছিলেন হ্যারি ব্রুক। লিটন কোনো ভুল করেননি। শূন্যে ঘুষি ছুঁড়ে মাহেদী নিজের সাফল্য উদযাপন করেছিলেন। চেয়েছিলেন কভারে থাকা সাকিবের কাছে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু অধিনায়ক ইশারায় তাকে থামিয়ে দেন। যেন বলতে চাইলেন, ‘ম্যাচ হাতের নাগালের বাইরে, উদযাপনের দরকার নেই।’
ওই সময়ে ৪৪ ওভারে ইংল্যান্ডের রান ছিল ৬ উইকেটে ৩২৭। শেষের ওভারগুলো খেলে তারা ৯ উইকেটে ৩৬৪ রানের বিশাল পুঁজি পায় যা ধর্মশালার মাঠে দলীয় সর্বোচ্চ। বিবর্ণ বোলিংয়ের পর ব্যাটিংটাও হলো ছন্নছাড়া। রান তাড়ায় ২২৭ রানে থেমে ধর্মশালা মিশনের শেষটা সুখকর হলো না সাকিব অ্যান্ড কোংদের।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিতে বাংলাদেশ যে আত্মবিশ্বাস পেয়েছিল, ইংল্যান্ডের কাছে হেরে তা দুঃস্বপ্নে রূপ নিলো। গা-ছাড়া ক্রিকেটে বেসামাল বাংলাদেশ। এদিন ব্যাটিং, বোলিংয়ে নুন্যতম লড়াইটাও করতে পারেনি। তাতে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচে বড় পরাজয়কে সঙ্গী করতে হলো সেমিফাইনাল খেলার প্রত্যাশায় থাকা লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে অতি পরিচিত নাম ডেভিড মালান। দেশের দুই ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে প্রায় নিয়মিতই খেলেন। তাতে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ তার চেনা। গত মার্চেই ঢাকায় ১১৪ রানের নজরকাড়া ইনিংস খেলেছিলেন। আজ ধর্মশালায় ফের ভোগালেন এই ব্যাটসম্যান। খেললেন ১৪০ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। যেখানে বাউন্ডারির সমারোহ সাজিয়ে ১৬ চার ও ৫ ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন।
সমান তালে এগিয়েছেন আরও দুই ব্যাটসম্যান জনি বেয়ারস্টো ও জো রুট। ওপেনিংয়ে বেয়ারস্টো ৫৯ বলে ৫২ এবং রুট ৬৮ বলে করেছেন ৮২ রান। টপ অর্ডারে এই তিন ব্যাটসম্যান বাদে ইংল্যান্ডের হয়ে রান পাননি কেউ। তাদের বিধ্বংসী সেই ব্যাটিংয়েই ইংরেজরা রানের পাহাড় ছুঁয়ে ফেলে।
টস হেরে ব্যাটিং করতে নেমে ইংল্যান্ড উদ্বোধনী জুটিতেই ১১৫ রান করে। জনি বেয়ারস্টো ও ডেভিড মালান তুলে নেন ফিফটি। প্রথম সাফল্য পেতে সাকিব তখন ছয় বোলারকে দিয়ে হাত ঘুরিয়েছেন। কিন্ত ফলাফল শূন্য।
ড্রিংকস ব্রেকের পরপরই সাকিব এনে দেন ব্রেক থ্রু। বেয়ারস্টোকে বোল্ড করে ভাঙেন উদ্বোধনী জুটি। অন্যদিকে মালান ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী। সঙ্গে যোগ দেন রুট। দুজনের ব্যাট যেন তলোয়ার হয়ে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণকে ক্ষত বিক্ষত করে দেন। এবারের জুটিটা আরও বড়, আরও ভয়ংকর। মালান ও বেয়ারস্টো ১০৭ বলে ১১৫ রান করেছিলেন। রুট ও মালান ১১৭ বলে করেন ১৫১ রান। তখন ৩৭ ওভারেই ইংল্যান্ডের রান ২৬৬।
বাংলাদেশ স্বভাবতই বুঝছে পেরেছিল শেষ ওভারে বিধ্বংসী কিছু আসতে যাচ্ছে। কারণ বাটলার, লিভিংস্টোন, ব্রুকের তখনও ক্রিজে আসা বাকি। কিন্তু রুট ও মালানকে দ্রুত ফেরানোর পর পরের ব্যাটসম্যানদের উড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। যার কৃতিত্ব মাহেদী হাসান ও শরিফুল ইসলামের।
মাহেদী হাসানের বলে মালান বোল্ড হন। রুটের উইকেট নেন শরিফুল। বাঁহাতি পেসার এরপর বাটলার ও লিভিংস্টোনকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা তৈরি করেন। কিন্তু স্যাম কুরান বল ঠেকিয়ে দেন।
লেজের ব্যাটসম্যানরা অবদান রেখে ইংল্যান্ডের রানকে পরবর্তীতে নিয়ে যায় চূঁড়ায়। ৭১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মাহেদী হাসান ছিলেন দলের সেরা। এছাড়া ৭৫ রানে ৩ উইকেট নেন শরিফুল ইসলাম।
রানের পাহাড় ছোঁয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল দারুণ জবাব। কিন্তু ইংলিশদের বাঁহাতি পেসার রিচ টপলির আক্রমণে শুরুতেই টপলেস বাংলাদেশ। ২৬ রান তুলতেই ড্রেসিংরুমে তানজিদ, শান্ত ও সাকিব। পরপর দুই বলে তানজিদ ও শান্ত আউট হন। সাকিবকে দারুণ এক বলে বিভ্রান্তিতে ফেলে বোল্ড করেন টপলি। মিরাজের ওপর আশা ছিল। কিন্তু ক্রিস ওকসের বলে আউট হয়ে যান ৮ রানে। ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ এরপর ম্যাচে ফেরার লড়াই করলেও পারেননি।
বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল লিটন দাসের রানে ফেরা। তার অফফর্ম ভাবাচ্ছিল দলকে। আজ প্রথম ওভারেই তিন চার হাঁকিয়ে ভালো কিছুর আশা দেখান। সেখান থেকে আক্রমণ চালিয়ে ইনিংস সাজাতে শুরু করেন। ৩৮ বলে পেয়ে যান এগারতম ফিফটি। ইনিংসটিকে তিন অঙ্কে রূপ দেওয়ার সুযোগও ছিল। কিন্তু সত্তরের ঘরেই আটকে যান। ওকস নেন প্রতিশোধ। তার ভেতরে ঢোকানো বলে লিটন ৭৬ রানে ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে। ৬৬ বলে ৭ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি যদি লম্বা হতো আজকের গল্পটা ভিন্ন হতে পারত কিনা কে জানে। তবে এই ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি লিটনের রানে ফেরা।
ফিফটি পেয়েছেন মুশফিকুর রহিমও। টপলির চতুর্থ শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ৬৪ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৫১ রান করেন। শেষ দিকে তাওহীদ হৃদয়ের ৩৯ ও বাকিদের ছোট ছোট অবদানে দুইশ পেরিয়ে যায় দলের স্কোর।
১৩৭ রানের বিশাল জয়ে রান রেটে এগিয়ে হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছে ইংল্যান্ড। আর বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসে পানি ঢালল হতশ্রী এক পরাজয়ে। ধর্মশালা ছাড়ার আগে এই পরাজয় নিশ্চয়ই ভুলে যেতে চাইবে দল। নিজেদের ভুলভ্রান্তি শুধরাতে খুব বেশি সময় পাবে না বাংলাদেশ। শুক্রবার চেন্নাইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ড।