রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক: যেভাবে ছড়াল প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ৩.৫১ এএম
  • ৩৮১ বার পড়া হয়েছে

মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে বিতর্কের জেরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে স্কুল এবং কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। কর্ণাটকের এই বিতর্ক বিশ্বের দৃষ্টিতে এসেছে নোবেল পুরস্কার-জয়ী মালালা ইউসুফজাই সুর চড়ানোর পর।

মুসলিম ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে হিজাব পরার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ায় দক্ষিণ ভারতের ওই রাজ্যের সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিজাব পরার পক্ষে আদালতের অনুমতি চেয়ে মুসলিম মেয়েদের একটি পিটিশনের শুনানি বুধবার কর্ণাটকের হাইকোর্টে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

কর্ণাটকের সরকারি একটি কলেজে হিজাব পরা নিয়ে মুসলিম ছাত্রীদের আন্দোলন অন্যান্য কলেজে ছড়িয়ে পড়ার পর ছয়জন ছাত্রী আদালতে ওই পিটিশন দায়ের করেছেন। মুসলিম নারীদের হিজাবের বিরুদ্ধে সেখানকার কয়েকটি হিন্দু সংগঠন গেরুয়া ওড়না পরে পাল্টা আন্দোলন শুরু করেছে। গেরুয়া ওড়নাকে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়।

১৫ বছর বয়সে নারী শিক্ষার অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য পাকিস্তানে তালেবানের হামলায় বেঁচে যাওয়া মালালা ইউসুফজাই মঙ্গলবার মুসলিম নারীদের প্রান্তিককরণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতে এই বিতর্ক সংখ্যালঘু মুসলিমদের মাঝে ভয় এবং ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। তারা বলেছেন, দেশের সংবিধান তাদের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার নিশ্চয়তা দিয়েছে। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একদল উন্মত্ত যুবক বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিয়ে বোরকা পরা এক ছাত্রীকে হেনস্তা করছে। এ সময় হিজাব এবং গেরুয়া ওড়না পরা ছাত্রীদের উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় হয়।

বিরল এক পদক্ষেপ হিসাবে কর্ণাটকের আদালতের বিচারক পিটিশনের শুনানির সময় শিক্ষার্থী এবং অন্যান্যদের রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

কীভাবে শুরু হলো এই বিতর্ক?

কর্ণাটকের উদুপি জেলার একটি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজের ছয় ছাত্রীকে হিজাব পরার কারণে ক্লাসে ঢুকতে বাধা দেওয়ার পর এই সমস্যা মানুষের নজর কাড়তে শুরু করে। উপকূলীয় অঞ্চল কর্ণাটকের সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীল তিনটি জেলার একটি উদুপি; যা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শক্ত ঘাঁটি।

বিশ্লেষকরা প্রায়ই এই অঞ্চলটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু রাজনীতির পরীক্ষাগার হিসেবে অভিহিত করেন। কর্ণাটকের ক্ষমতায়ও রয়েছে বিজেপি। কলেজটি বলছে, কলেজের ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার অনুমতি রয়েছে। শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় তদের হিজাব খুলে রাখতে বলা হয়।
কিন্তু কলেজে বাধ্যতামূলক ইউনিফর্ম পরা প্রতিবাদকারী মুসলিম ছাত্রীদের যুক্তি, শ্রেণিকক্ষেও তাদের চুল ঢেকে রাখার অনুমতি দিতে হবে। আলমাস এএইচ নামের এক ছাত্রী বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, ‘আমাদের অল্প কয়েকজন পুরুষ শিক্ষক আছেন। পুরুষদের সামনে আমাদের চুল ঢেকে রাখতে হয়। যে কারণে আমরা হিজাব পরি।’

তবে দেশটির ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার ছাত্র-সংগঠন ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার পক্ষে আন্দোলন করছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছেন মুসলিম ছাত্রীরা।
অন্যান্য কলেজে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল এই আন্দোলন?

এর আগেও কর্ণাটকের আরও কয়েকটি কলেজে মুসলিম নারীদের হিজাব পরার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দেখা গেছে। কিন্তু উদুপির ওই কলেজের ছয় শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসে থাকার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর এই আন্দোলন নতুন রূপ পেতে শুরু করে।

অল্প সময়ের মধ্যে রাজ্যের অন্যান্য কিছু কলেজে হিন্দু শিক্ষার্থীরা গেরুয়া শাল পরে ক্লাসে আসতে শুরু করে। উভয় পোশাকই ক্যাম্পাসে পরা যাবে না, এমন নির্দেশনা জারি করতে বাধ্য হন কলেজ কর্মকর্তারা।

গত সপ্তাহে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হিজাব পরা একদল ছাত্রীকে কলেজে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। উদুপি জেলার কুন্দাপুরের একটি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এই ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
হিজাব পরা সহপাঠীদের বিরুদ্ধে মিছিল করতে শুরু করে হিন্দু শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন। মঙ্গলবার আদালতে আবেদনের শুনানি শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে, কিছু শহরে হিন্দু এবং মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ এমনকি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। কিছু কিছু এলাকায় ঔপনিবেশিক যুগের আইন ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়। এই আইনে কোনও স্থানে চারজনের বেশি জমায়েত হতে পারেন না।
মান্দিয়া জেলার একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, বোরকা পরা এক তরুণীর পিছু পিছু আসছে গেরুয়া শাল পরা একদল তরুণ। তারা ওই তরুণীকে লক্ষ্য করে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দেন। এ সময় ওই তরুণী মাঠে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই তরুণীকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

মুসকান খান নামের ওই ছাত্রী বলেন, কলেজের অধ্যক্ষ তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি তাকে সমর্থন করবেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেন, ‘অন্য কিছু মুসলিম মেয়েকেও একইভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। কলেজ প্রশাসন এবং অধ্যক্ষ কখনই আমাদের বোরকা পরতে বাধা দেননি। তাহলে আমি কেন বহিরাগতদের কথা শুনব?’

কর্ণাটকের জ্যেষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, এগুলো ‘ছোটখাট ঘটনা’ এবং বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

রাজ্য সরকার কী বলছে?

কর্ণাটকের শিক্ষামন্ত্রী নাগেশ বিসি কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ক্যাম্পাসে হিজাব এবং গেরুয়া ওড়না— উভয়ই নিষিদ্ধ করা উচিত।

শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে দুর্বৃত্তরা উসকানি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক শাখা এই অঞ্চলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে জানিয়ে নাগেশ বিসি বলেন, ‘এটা মূলত রাজনীতি। আগামী বছর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের কারণেই এসব ঘটছে।’

এখন পর্যন্ত আদালত কী বলেছেন?

প্রতিবাদকারীদের পক্ষে আদালতে এখন পর্যন্ত দু’টি পিটিশন দায়ের হয়েছে। এর একটিতে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, মানুষ কী পরবেন, ভারতীয় সংবিধানে সেটা বেছে নেওয়ার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। অন্যটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে; যেখানে হিজাব এবং মাথার স্কার্ফ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পিটিশন দায়েরকারীদের আইনজীবী হিজাব নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের আদেশ ‘অসাংবিধানিক এবং বেআইনি’ বলে যুক্তি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগে ক্লাসে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে আদালতকে একটি অন্তর্বর্তী আদেশ পাস করতে বলেছেন।

আদালতের বিচারক দীক্ষিত বলেছেন, তিনি সংবিধান মেনে কাজ করবেন। ‘আমি যে শপথ নিয়েছি, সেই শপথ অনুযায়ী কাজ করব। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকবে, এটা ভালো পরিস্থিতি নয়।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort