শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

ফোনালাপ থেকে প্রেম, ‘ধর্ষণের’ পর খুন

  • আপডেট সময় সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১, ৪.১৫ এএম
  • ৪৬৬ বার পড়া হয়েছে

ঘটনাটি গত মঙ্গলবারের (৩ আগস্ট)। টাঙ্গাইলে ভূয়াপুর থানার বীর বরুয়া নামক গ্রামে সড়কের পাশে পড়ে ছিল বস্তাবন্দী এক মেয়ের লাশ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।

জাতীয় পরিচয় পত্র বা অন্য কোনো সূত্র না থাকায় তাৎক্ষণিক পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি সেই মেয়েটির লাশের। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় ভূয়াপুর থানা পুলিশ নিহতের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্ত করিয়ে ভূয়াপুর ছাব্বিশা কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করে।

অবশেষে লাশ উদ্ধারের ঘটনার ৫ দিন পর জানা গেছে সেই মেয়ের পরিচয়। শুধু তাই নয় মোবাইলে মিথ্যা পরিচয় দেওয়া শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস নামের এক নর সুন্দের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই মেয়ের। এরপর দেখা করতে গিয়ে প্রথমে ধর্ষণের শিকার হয় সেই মেয়ে। ধর্ষণের পর মেয়েকে হত্যাও করেছে সেই প্রেমিক। এরপর লাশ গুম করতে তার তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ফেলে গেছে সড়কের পাশে।

লাশ দাফনের পর যেভাবে মিলল পরিচয়

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে ঘটনার দিনেই টাঙ্গাইলের পিবিআই ইউনিটের পুলিশ পরিদর্শক (নি.) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান আনসারীর নেতৃত্বে একটি ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিল। সেই দিনই তারা প্রয়োজনীয় তথ্যই সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিক পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় লাশের পরিচয় শনাক্তের জন্য পিবিআই হেডকোয়ার্টাসের ফেসবুক পেজ, বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রচার করা হয়। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা মেয়ের লাশ শনাক্তসহ হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখে পিবিআই।

পরবর্তীতে গত বৃহস্পতিকার (৫ আগস্ট) অজ্ঞাতনামা সেই মেয়ের লাশের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পিবিআই। এরপর নিহতের বাবা লাশের ছবি ও পরনের কাপড় দেখে জানান লাশটি তার মেয়ে খোদেজা খাতুনের।

এরপরই জানা যায়, নিহত ওই মেয়ের নাম খোদেজা খাতুন। বয়স ১৯ বছর। গত ২১ আগস্ট তার নানি বাড়ি মনতলা গিয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পথে নিখোঁজ হয় বলে জানায় তার পরিবার।

যেভাবে গ্রেপ্তার হত্যাকারীরা

পিবিআই টাঙ্গাইলের একটি টিম হত্যার রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করে। তারা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্নস্থানে অভিযান পরিচালনা করে হত্যা, ধর্ষণ ও লাশগুমের ঘটনায় জড়িত চারজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন- শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস (২৮), সৌরভ আহম্মেদ ওরফে হৃদয় (২৩), মো. মেহেদী হাসান ওরফে টিটু (২৮) ও মো. মিজানুর রহমান (৩৭)।

তারা পিবিআইয়ের কাছে খোদেজাকে ধর্ষণসহ হত্যা ও লাশ গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেয়। ধর্ষণসহ হত্যার ঘটনাস্থল ধনবাড়ী থানা এলাকায় আসামি মিজানের ভাড়া করা বাসায় বলে জানায়। তাদের দেওয়া তথ্য মতে লাশগুমের জন্য লাশ বহনকারী সিএনজি উদ্ধার করে পুলিশ।

যেভাবে প্রেম

পিবিআই জানায়, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেছে, শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস পেশায় একজন নর সুন্দর। আসামি সৌরভ আহম্মেদ ও আসামি মো. মেহেদী হাসান শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্রের স্যালুনের নিয়মিত কাস্টমার হওয়ার সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আর আসামি মিজান ও তাদের পূর্ব পরিচিত।

ঘটনার বেশ কিছুদিন পর একটি মোবাইল মিসকলের মাধ্যমে খোদেজার সঙ্গে শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাসের পরিচয় হয়। তখন আসামি কৃষ্ণ চন্দ্র দাস তার নাম সানি আহমেদ এবং একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে খোদেজার কাছে পরিচয় দেয়।

উক্ত পরিচয়ের সূত্র ধরেই মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথাবার্তার একপর্যায়ে খোদেজার সঙ্গে শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস ওরফে সানি আহমেদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হলে শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস (সানি আহমেদ) খোদেজাকে বিয়ে করাসহ উন্নত সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।

খোদেজা ও কৃষ্ণ চন্দ্র দাসের মিথ্যা প্রেমের ডিজিটাল ফাঁদে পা বাড়াতে থাকে। একপর্যায়ে সানি নামধারী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস খোদেজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। তার সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য সে খোদেজাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ফুসলাতে থাকে।

এক পর্যায়ে খোদেজা তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়। তখন শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস বিষয়টি তার বন্ধু সৌরভ ও মো. মেহেদী হাসানকে জানায়। তারা তিনজনে শলাপরামর্শ করে জায়গা ঠিক করার জন্য গত ১ আগস্ট বিকেলে সৌরভের মোটরসাইকেলে করে তাদের বন্ধু মিজানের বাড়িতে গিয়ে ৩/৪ ঘণ্টার জন্য মিজানের বাসার রুমটি ২ হাজার টাকায় ভাড়া করে। মিজান করোনাকালে আর্থিকভাবে সমস্যায় থাকায় তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়।

যেভাবে হত্যা

ঘটনার দিনে অর্থাৎ ২ আগস্ট কৃষ্ণ চন্দ্র দাস খোদেজাকে গোপালপুর থানা ব্রিজে দেখা করতে বলে। খোদেজা সরল বিশ্বাসে কৃষ্ণ চন্দ্র দাসের সঙ্গে দেখা করতে যায়। খোদেজা গোপালপুর থানা ব্রিজে পৌঁছালে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষারত থাকা শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস ও সৌরভ আহম্মেদ খোদেজাকে কোন একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে চায় আলাপ করা ও দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য।

খোদেজা তাদের প্রস্তাবে রেস্টুরেন্টে যেতে রাজি হয়। তখন সৌরভ আহম্মেদ তার মোটরসাইকেলে কৃষ্ণ খোদেজাকে তার পেছনে বসিয়ে নিয়ে যায়।

এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে রেস্টুরেন্টে না গিয়ে সৌরভ আহম্মেদের মোটরসাইকেল নিয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে আসামি মিজানের ভাড়া করা বাড়িতে নিয়ে যান। খোদেজা বিষয়টি বুঝতে পেরে আসামি সানী নামধারী কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা এখানে কেন?’ আসামি কৃষ্ণ কৌশলে খোদেজাকে বুঝায়, ‘আমার এক বন্ধু রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসবে, এটা আমার বন্ধু মিজানের বাসা, এখানে আমরা আলাপ করি। তোমার কোনো ভয় নেই, এ বাসায় মিজানের বউ ও সন্তান আছে, খারাপ কিছু হবে না।’ এতে খোদেজা ভরসা পায়। মিজানের ভাড়া বাসার একটি রুমে খোদেজা ও কৃষ্ণ বসে আলাপ করতে থাকে। তখন সৌরভ আহম্মেদ ও মো. মিজানুর রহমান ঘরের বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকে। এক পর্যায়ে শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে খোদেজাকে ধর্ষণ করে।

তখন খোদেজা বুঝতে পারে কৃষ্ণ প্রকৃতপক্ষে সানি আহমেদ নয় বরং সে একজন হিন্দু ও তার সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য সানি নাম ধারণ করেছিল। খোদেজা তখন কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করে, কিন্তু কৃষ্ণ তাকে ভয়ভীতি দেখায়, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে।

এরপর কৃষ্ণ আবারো তাকে ধর্ষণ করে। তখন খোদেজা সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে, কিন্তু অন্য আসামিরা ঘরের বাহিরে থেকেও কোনো সাহায্য করে না। শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস খোদেজাকে একাধিকবার ধর্ষণ করলে সে কান্নাকাটি ও চিৎকার শুরু করলে কৃষ্ণ চন্দ্র দাস খোদেজাকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তখন আসামিরা খোদেজার হত্যাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর জন্য ধনবাড়ী বাজার হতে ড্রিলিং মেশিন নিয়ে এসে তা দিয়ে রুমের স্টিলের দরজা বাহির থেকে কাটে। কিন্তু আসামি মিজান এই নাটক করতে রাজি হয় না, কারণ এতে সে ফেঁসে যেতে পারে। পরবর্তীতে শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস, সৌরভ আহম্মেদ ও মো. মিজানুর রহমান পরামর্শ করে লাশটি মিজানের ভাড়া বাসার রুমেই বস্তাবন্দী করে। বস্তাটি মিজানের বাসায় আগেই ছিল।

এরপর তারা মো. মিজানুরের মাধ্যমে আ. খালেকের একটি সিএনজি ১ হাজার ৫০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে এসে খোদেজার বস্তবন্দী লাশ আসামি কৃষ্ণ ও মিজান ধরাধরি করে সিএনজিতে ওঠায়। মিজান আগে সিএনজি চালাতো, তাই জানাজানি হওয়ার ভয়ে অন্য ড্রাইভার না নিয়ে মিজান নিজেই সিএনজি চালিয়ে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

তখন শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস ও সৌরভ আহম্মেদ সিএনজির পেছনে বস্তাবন্দী লাশ নিয়ে বসেছিল। তারা লাশটি ভূয়াপুর থানার বীর ভরুয়া নামক গ্রামে ভূয়াপুর-তারাকান্দি সড়কের পাকা রাস্তার পশ্চিম পাশে ঢালুতে বস্তাবন্দী অবস্থায় ফেলে রেখে যায়।

এ সময় তারা খোদেজার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগটি যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। পরে ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আসামি মিজান তার বাসা পরিবর্তন করে অন্য একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য কৃষ্ণ চন্দ্র ও হৃদয়ের কাছে বেশি টাকা দাবি করে। তখন আসামি কৃষ্ণ চন্দ্র মিজানকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নিজেদের মধ্যে বিষয়টি দফারফা করে।

পুলিশের ভাষ্য

এই বিষয়ে টাঙ্গাইল পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সিরাজ আমীন বলেন, ‘নিহত খোদেজার বাবা খোকন মন্ডল বাদী হয়ে এই ঘটনায় ভূঞাপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। সেই মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort