ইসলামে দেনমোহরের গুরুত্ব অপরিসীম। নারী পুরুষের হৃদয়ে প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য এক আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিবাহবন্ধন।
কোনো পুরুষ কেবল বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেই এ পবিত্রময় আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করতে পারে। তাই বিবাহকে বলা হয় শান্তির প্রতীক।
ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার প্রদান করেছে সেসবের অন্যতম হচ্ছে বিয়ের সময় প্রাপ্য দেনমোহর। দেনমোহর কোনো পণ্যের চুক্তিমূল্য নয় বরং এটি একজন স্বামীর ওপর অর্পিত একটি দায়িত্ব, একই সঙ্গে একজন স্ত্রীর অধিকার যা পবিত্র কুরআন দ্বারা স্বীকৃত।
পবিত্র কুরআন কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহরনা খুশিমনে দাও।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত : ৪)। স্বামী যাতে চুক্তি ও অঙ্গীকার মোতাবেক মোহরানার টাকাটা স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় বিনাদ্বিধায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে প্রদান করে, ওই আয়াতে এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। এখানে খুশি মনে দেওয়ার বিষয়টি আমাদের এ শিক্ষাই দেয় মোহরানার অঙ্ক যেন স্বামীর সামর্থ্যে বাইরে না হয় এবং তা পরিশোধ করতে স্বামীর যেন প্রাণান্তকর অবস্থার সৃষ্টি না হয় বরং স্বেচ্ছায় ও সানন্দে পরিশোধ করতে পারে।
মোহরানা মূলত একটি সম্মানি। যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে, তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে, নারী নিজেকে স্বামীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ইসলাম ও বিশ্বনবি (সা.) বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক জীবন্ত আদর্শ স্থাপন করেছেন। মানব মন ও মানব সমাজে নারী প্রগতির গোড়াপত্তন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। ইসলামে নর-নারী উভয়ে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে স্বীকৃত এবং কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গ লাভের সম অধিকার প্রাপ্য। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘তিনি তোমাদের এক-ই সত্তা হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জীবনসঙ্গিণীকে একই উপাদান হতে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত : ১)। পারিবারিক জীবনে সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও সার্বিক মূল্যায়নে ইসলাম নারী জাতিকে পুরুষের অধিক মান-মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, যা অন্য কোনো ধর্ম বা জাতিতে করেনি। বিশেষ করে বিয়েতে দেনমোহরানার অধিকার প্রদানের মাধ্যমে তাদের সম্মান আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে ইসলাম।
ইসলামি শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো-যখন কোনো পুরুষ কোনো নারীকে বিয়ে করে ঘরে আনবে তখন যেন তাকে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে আনে এবং এমন কিছু উপহার দেয়, যা তাকে সম্মানিত করে। ইসলামে মহিলাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও সুখী-সমৃদ্ধ করার জন্যই মোহরানা নির্ধারণ করেছে। আর এ মোহরানা অবশ্যই আদায় করা উচিত। অনেকেই মনে করে যে, কেবল খোলা বা তালাকের ক্ষেত্রে মোহরানা দিতে হয়। বিষয়টি মোটেও তা নয় বরং বিয়ের পরই তা আদায় করতে হয়। ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার প্রদান করেছে-এর মধ্যে অন্যতম হলো মোহরানা। দেনমোহর ছাড়া বিয়েই হতে পারে না।
বিয়ের সময় থেকে আজীবন স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর। যেভাবে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘পুরুষগণ স্ত্রীলোকদের ওপর অভিভাবক, কেননা আল্লাহ তাদের কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ কারণেও যে, তারা নিজেদের ধন-সম্পদ থেকে স্ত্রীলোকদের জন্য খরচ করে।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত : ৩৪)। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রা.) বলেছেন, ‘আমি মহানবি (সা.)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন, ‘খোদা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, খোদা তোমাকে যা পড়তে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পড়তে দাও এবং তাকে থাপ্পড়ও মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না।’ (আবু দাউদ)। নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবি (সা.) বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই (সা.) পৃথিবীতে প্রথম নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বিশেষ করে বিয়েতে দেনমোহরের অধিকার প্রদান করে নারীর সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোনো ধর্মই এভাবে নারীদের অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেনি।
মোহরানার বিষয়ে পবিত্র কুরআন কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে নবি! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের দেনমোহর তুমি প্রদান করেছ।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫০)। দেনমোহর না দেওয়ার নিয়তে বিয়ে ব্যভিচার সমতুল্য। কোনো পুরুষের যদি মোহরানা আদায়ের ইচ্ছা না থাকে তার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো একটা পরিমাণ মোহরানা ধার্য করে কোনো নারীকে বিয়ে করল, অথচ আল্লাহ জানেন তা পরিশোধ করার ইচ্ছে তার নেই, এ ব্যক্তি আল্লাহর নামে তার স্ত্রীকে প্রতারিত করল এবং অন্যায়ভাবে তার সতীত্ব নিজের জন্য হালাল মনে করে ভোগ করল এমন ব্যক্তি কিয়ামতে ‘জিনাকারী ব্যভিচারী হিসাবে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ)।
রাসূলে আকরাম (সা.) হজরত আলী (রা.)কে নির্দেশ দিয়েছেন, কিছু দেওয়ার আগে বিবির কাছে যেয়ো না। হজরত আলী (রা.) নিবেদন করলেন, আমার কাছে তো কিছুই নেই। মহানবি (সা.) বললেন, তোমার কাছে যে লোহার বর্মটি ছিল সেটি কোথায়? ওটাই ফাতেমা (রা.)কে দিয়ে দাও। সাহাবি হজরত আলী (রা.) নির্জনবাসে যাওয়ার আগেই বর্মটি ফাতেমা (রা.)কে দিয়ে দেন’ (আবু দাউদ)। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ছিল কিছু না কিছু মোহরানা যেন হজরত আলী (রা.) নির্জনবাসের আগেই পরিশোধ করেন। কিন্তু হজরত আলী (রা.) পূর্ণ মোহরানাই পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। কারণ অন্য একটি হাদিসে হজরত আলী (রা.) বলেন, আমি ওই বর্মটিকে বারো উকিয়ায় বিক্রি করেছি। ওটাই ফাতেমা (রা.)-এর দেনমোহর।’ (মাজমাউয যাওয়াইদ)।
দুপক্ষের আলাপের ভিত্তিতে মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করা শ্রেয়। মূলত বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটা বিবেচনায় রেখে দেনমোহর ঠিক করা হয়। অনেক সময় সামাজিক লৌকিকতার প্রতি লক্ষ করে অনেক বেশি মোহরানা ধার্য করা হয়, যা মোটেও ঠিক নয়। এ বিষয়ে হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের মোহর বেশি ধার্য করবে না, কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখেরাতে আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো, তবে সে ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে রাসূল (সা.) অধিক উপযোগী ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) বারো উকিয়ার বেশি দিয়ে তার কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন, তার কোনো কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।’ (তিরমিজি)।
মহানবির (সা.) অতুলনীয় আদর্শ দেখুন, হজরত খাদিজা (রা.) তার অঢেল ধন-সম্পদের সবকিছু রাসূল করিম (সা.)-এর খিদমতে পেশ করলেন, আর তিনি (সা.) এ সম্পদ কী করলেন, গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন। নিজের জন্য কিছুই রাখলেন না। আজ আমরা যা ইসলামে নেই সেসবই বেশি করে করছি। বর্তমানে দেখা যায় ছেলেপক্ষ মেয়ে পক্ষের কাছে টাকা, অলঙ্কার, গাড়ি, বাড়ি, তৈজষপত্রাদির বড় বড় দাবি আদায় করে থাকে। আর সে মোতাবেক না দিলে চলে নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতেও দ্বিধা করে না। আমরা শ্রেষ্ঠ নবির উম্মত হওয়ার দাবি করছি ঠিকই, সত্যিই কী আমাদের মাঝে বিশ্বনবির (সা.) আদর্শ বিদ্যমান? আমরা কী আমাদের স্ত্রীকে তাদের অধিকার ও যথাযথ সম্মান প্রদান করছি? আমরা কী তাদের দেনমোহর আদায় করেছি? উত্তর যদি না হয় তাহলে অনেক ভয়ের বিষয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।