গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রনিনিধি- মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে সদ্য চালু হওয়া একটি পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের ওপর নৌ ডাকাত দলের সদস্যরা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশ। উভয় পক্ষের মধ্যে শতাধিক গোলাগুলি হয়েছে।
সোমবার বিকেল সোয়া পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পসংলগ্ন মেঘনা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। ডাকাতদলের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো থানা থেকে লুট করা বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। শুধা হামলা করেই শেষ নয় রাতে ড্রোন উড়িয়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশের গতি বিধি লক্ষ্য রেখেছে। নৌ সন্ত্রাসীদের এ ধরনের কর্মকান্ডে আতংঙ্কে ছড়িয়ে পরেছে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে।
জামলপুর এলাকার বাসিন্দা উজ্জ্বল দেওয়ান সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার বাড়ির পাশে পুলিশ ক্যাম্প। বিকেলে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি পুলিশ ও ডাকাত দলের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। এতে আমাদের গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকা থমথমে হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ ভয়ে যার যার ঘরে অবস্থান করছে।’
ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোমবার বিকেল পাঁচটার পরপর পাঁচ–ছয়টি দ্রুতগতির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পসংলগ্ন মেঘনা নদীতে মহড়া শুরু করে নৌ ডাকাত নয়ন, পিয়াস ও রিপনের পক্ষের ৩০–৪০ জন সদস্য। এ সময় ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা ডাকাত দলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নদীতে অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। পুলিশের প্রস্তুতির বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে ডাকাত দলের সদস্যরা চাঁদপুরের বেলতলীর দিকে গিয়ে আড়াল হয়ে যায়।
কিছু সময় পর সোয়া পাঁচটার দিকে মাথায় হেলমেট পরে আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি, ককটেল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসে। ক্যাম্পে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর এক ককটেল ও গুলি ছুড়তে থাকে ডাকাত দলের সদস্যরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। এ সময় ডাকাতদের পক্ষ থেকে প্রায় ১০০টি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে ২০টির মতো গুলি ছোড়া হয়। আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ট্রলার নিয়ে মতলবের দিকে চলে যায় হামলাকারীরা।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের মেঘনা নদী ও শাখা নদীতে অবৈধ বালুমহাল পরিচালনা, নৌযানে চাঁদাবাজি করে আসছে নয়ন, পিয়াস, রিপন ও লালু বাহিনীর সদস্যরা। গত এক বছরে নদীতে কয়েক দফা গোলাগুলিতে তাদের হাতে খুন হন অন্য ডাকাত পক্ষের সরদার বাবলা। এক মাস আগে বালু উত্তোলনে বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন আবদুল মান্নান ও হৃদয় আহমেদ নামের আরও দুজন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার জামালপুর গ্রামে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প চালু করা হয়। গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), দুজন উপপরিদর্শকসহ ৪০ জন পুলিশ সদস্য দিয়ে এ ক্যাম্প শুরু করা হয়।
ঘটনার সময় ওই পুলিশ ক্যাম্পে ছিলেন গজারিয়া থানার ওসি মো. আনোয়ার আলম আজাদ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌ ডাকাত নয়ন, পিয়াস, রিপনের নেতৃত্বে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পাঁচ-ছয়টি ট্রলার নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীদের দলে ৪০ জনের ওপরে সদস্য ছিল। তারা দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ প্রস্তুতি নিয়ে হামলা করেছিল। তাদের হাতের অস্ত্রগুলো থানা থেকে লুট করা। তারা আমাদের লক্ষ্য করে শতাধিক গুলি করেছে। আমাদের দিক থেকে ১৯টির মতো গুলি করা হয়েছে। আমাদের কোনো পুলিশ সদস্য আহত হয়নি। তবে কোনো সন্ত্রাসী আহত হয়েছে কি না, তা আমরা বলতে পারব না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, নয়ন, পিয়াস, রিপন ও লালু বাহিনীর ভয়ে এলাকার মানুষ মুখ খোলার সাহস পান না। কেউ কথা বলতে চাইলে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হতো। তাদের ভয়ে ইউনিয়নটির শতাধিক পরিবার গ্রামছাড়া হয়েছিল। পুলিশ ক্যাম্প চালু হওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষজন গ্রামে ফিরতে শুরু করেছিলেন। পুলিশের তৎপরতায় ডাকাত দলও তাদের কার্যক্রম চালাতে বাধার মুখে পড়ছে। এ জন্যই ডাকাতেরা চাচ্ছে ভয়ভীতি দেখিয়ে হোক আর হামলা করেই হোক, এখান থেকে পুলিশ ক্যাম্প বন্ধ করে দিতে। ডাকাত দলের সদস্যরা অনেক শক্তিশালী। যেকোনো সময় আবারও হামলা হতে পারে।
এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহম্মদ শামসুল আলম সরকারের দাবি, পুলিশ ক্যাম্প হওয়ার পর নৌ ডাকাতরা আর সুবিধা করতে পারছে না। এতে তারা পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত। তিনি বলেন, ‘তবে আমরা সাধারণ মানুষকে বলতে চাই, পুলিশ তাদের পক্ষে রয়েছে। পুলিশ সদস্যরা তাদের পেশাদারত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। কোনো ডাকাত–সন্ত্রাসীকে পুলিশ ভয় পায় না। গুয়াগাছিয়ার সব ডাকাত–সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে।’