আমাদের প্রিয় নবী হাজারো গুণে সমৃদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ব মানবতার দর্পণ, যা দেখে মানুষ নিজের ভেতর-বাহির শুধরে নিতে পারে। এর মাঝে এমন কিছু গুণ রয়েছে, যার মাঝে গুণগুলো থাকবে তাকে আল্লাহ তাআলা শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন। সিরাতে নববীর বাঁকে বাঁকে সেসব বিষয় লুকিয়ে আছে। প্রিয় রাসুলের এমন ছয়টি গুণ নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
এক. পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা। শুদ্ধ চিন্তার অধিকারী এবং অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর সঠিক সিদ্ধান্তবলি এর প্রমাণ বহন করে। তিনি কোনো ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। সদা সজাগ থেকে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি তিনি স্বাভাবিকভাবে সামলে নিয়েছেন। বরং তিনি যেকোনো জিনিসের শুরুতেই এর পরিণতি চিন্তা করতেন এবং সেটা ভেবেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারতেন। যেমন হোদাইবিয়ার সন্ধি ছিল পট-পরিবর্তনের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এবং মুসলমানদের জন্য বিজয়ের এক শুভলগ্ন।
দুই. প্রিয়নবী (সা.) যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে অবিচল থাকতেন। যেকোনো দুর্ভোগ দুরবস্থায় ধৈর্যের মূর্তিমান ছিলেন। অথচ রাসুল (সা.) তখন কঠিন দুঃখ-কষ্টে নিপতিত তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। প্রতিটি মুহূর্তে তিনি শান্তশিষ্ট। মক্কা নগরীতে নিজ গোত্র থেকে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, যে কঠিন জীবন যাপন করেছেন তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তিনি তাঁর নিজস্ব স্বভাব প্রতিপত্তি নিয়েই স্থিরচিত্ত ছিলেন। হেরা গুহায় যখন কাফেররা রাসুলকে ধরে ফেলার উপক্রম হয়ে গিয়েছে সে অবস্থায় তিনি আল্লাহর কালাম পাঠ করেন। আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না করো, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বলেন বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪০)
তিন. দুনিয়াবিমুখতা ও তার প্রতি বিরাগ। সর্বদা তিনি অল্পতেই তুষ্ট থাকতেন। দুনিয়ার সজীবতা ও সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। অথচ তিনি হেজাজ থেকে ইরাকের ভূমি পর্যন্ত তার করতলে ছিল। সুদূর ইয়েমেন থেকে ওমান পর্যন্ত পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁরই করতলে। অথচ তিনি এ থেকে কোনো কিছু সঞ্চয় বা সংরক্ষণ করা থেকে সম্পূর্ণ ছিলেন বিমুখ। নিজের পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যাননি, যেন তার পরিবার লোকেরাও এর প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যায়। কোনো বিলাসবহুল বাড়িও নির্মাণ করেননি। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) যখন মৃত্যুবরণ করেন তার বর্ম কি ইহুদির কাছে বন্ধক ছিল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর বর্মটি ত্রিশ সা (প্রায় ৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে এক ইয়াহুদির কাছে বন্ধক ছিল। (বুখারি, হাদিস : ২৯১৬)
চার. প্রিয় নবী (সা.) নিজ অনুসারীদের সঙ্গে ছিলেন সর্বোচ্চ বিনয়ী। তাদের জন্য নিজের ডানাকে সর্বদা নিচু রাখতেন। বিনয় ও নম্রতায় তিনি ছিলেন অগ্রনায়ক। তিনি বাজারে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতেন। মাটির ওপর বসতে কোনো সংকোচবোধ করতেন না। সঙ্গী-সাথির সঙ্গে হাসি-কৌতুক করতেন। অথচ তিনি বিশ্বনবী, তিনি শ্রেষ্ঠ মানব। আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এলো। তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বলেন। তার কাঁধের গোশত (ভয়ে) কাঁপছিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি শান্ত হও, স্বাভাবিক হও। কারণ আমি কোনো রাজা-বাদশা নই, বরং আমি শুকনা গোশত খেয়ে জীবনধারিণী এক মহিলার পুত্র। (ইবনে মাজা, হাদিস: ৩৩১২)
এটাই ছিল আমাদের প্রিয় নবীর বৈশিষ্ট্য। তিনি উত্তম চরিত্রের ওপর জন্মগ্রহণ করেছেন। এটাই ছিল তাঁর প্রকৃত স্বভাব।
পাঁচ. রাসুলের সহনশীলতা ও গভীরতা ছিল অসাধারণ। যেকোনো অপছন্দনীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে সহনশীল রাখতেন। কারো অজ্ঞতা কিংবা মূর্খতার কারণে কোনো অশোভনীয় আচরণ প্রকাশ পেলে গম্ভীর থাকতেন। তার সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে জড়াতেন না। অথচ তিনিই আরবের বিরোধী দল থেকে কত ধরনের আঘাত সহ্য করেছেন। বিভিন্ন অশোভনীয় আচরণের শিকার হয়েছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ গম্ভীর। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে পথ চলছিলাম। তখন তিনি নাজরানে প্রস্তুত মোটা পাড়ের চাদর পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এক বেদুইন তাঁকে পেয়ে খুব জোরে টেনে দিল। অবশেষে আমি দেখলাম, জোরে টানার কারণে নবী (সা.)-এর স্কন্ধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। অতঃপর বেদুইন বলল, ‘আল্লাহর যে সম্পদ আপনার কাছে আছে তা থেকে আমাকে কিছু দেওয়ার আদেশ দিন।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন, আর তাকে কিছু দেওয়ার আদেশ দিলেন। (বুখারি, হাদিস: ৩১৪৯)
ছয়. রাসুলের ওয়াদা রক্ষা ও কৃত ওয়াদা পূর্ণ করা। তিনি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি, কখনো কৃত ওয়াদার বিপরীত করেননি। ওয়াদা ভঙ্গ করাকে তিনি গুরুতর অন্যায় মনে করতেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠী ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। তিনি ঘোষণা করেছেন, যার আমানতদারি নেই তার ঈমানও নেই এবং যার ওয়াদা ও অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দ্বিনও নেই।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৪০৪৫)