ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুই দেশের সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে সংকট বেড়েছে। অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকটে স্বল্পমেয়াদে ভারত ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন। তবে এই টানাপড়েন প্রভাব পড়তে পারে দুই দেশের বাণিজ্যে।
কানাডায় গত বছর একজন শিখ ধর্মাবলম্বীকে হত্যার মাধ্যমে শুরু হওয়া তিক্ততা ক্রমে বেড়ে চলেছে। এর প্রেক্ষাপটে কানাডা ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক এবং আরও পাঁচজনকে বহিষ্কার করেছে। ভারত পাল্টা জবাব হিসেবে, ছয় কানাডিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
বিশ্লেষকদের বরাতে রয়টার্স লিখেছে, ‘টিট-ফর-ট্যাট’ পদক্ষেপ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন নিম্নস্তরে নিয়ে গেছে। তবে এতে নরেন্দ্র মোদি এবং জাস্টিন ট্রুডোর ওপর খুব প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। উভয় নেতাই তাদের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন এবং দুজনেই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
এই পদক্ষেপটি জাতীয় নিরাপত্তার বাজপাখি হিসেবে মোদির ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, আমি মনে করি মানুষ ভারত সরকারকে একটি উন্নত দেশের ভয়ভীতি ও জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখবে। জনগণ প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং সরকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
প্রতিবেদন বলছে, ভারতের পাঞ্জাবের বাইরে শিখদের সর্বোচ্চ বাস কানাডায়। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ শিখ সম্প্রদায়ের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিখরা আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য বিক্ষোভ করে চলছে। এর পেছনে কানাডায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি দায়ী বলে অভিযোগ করছে ভারত।
নয়াদিল্লিভিত্তিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান হর্ষ পান্ত বলেছেন, ট্রুডো যত বেশি ভারতকে লক্ষ্য করেছেন, মোদির পক্ষে ততই ভালো। একটি দেশের নেতা হিসেবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য। মোদি এবং তার জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন হবে না।
এদিকে ট্রুডোর লিবারেল পার্টি ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের দৌড়ে এখন অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তার ক্ষেত্রেও একটা প্রভাব ফেলছে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ। ট্রুডোর সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালনকারী বামঘেঁষা বিরোধী দলের নেতারাও ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কারের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন।
তবে পিটারবরোর ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক ক্রিস্টিন ডি ক্লারসি বলেছেন, ট্রুডোর জন্য যে কোনো পদক্ষেপই দীর্ঘমেয়াদে কাজ করবে না। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর তালিকা যা তাকে সমাধান করতে হবে; তা দূর দেশের এই একক ঘটনার চেয়ে অনেক দীর্ঘ এবং আরও জটিল।
রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিখ সম্প্রদায়ের একজন নেতা বলেছেন, তিনি বহিষ্কারের আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে এই বিরোধ ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে আশা করেন না।
এদিকে নয়াদিল্লিভিত্তিক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেছেন, এই বিরোধটি যখন চলছে, তখন উভয় দেশের প্রসারিত অর্থনৈতিক পতন এড়াতে সাবধানতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০১৯ এবং ২০২৩ অর্থবছরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্য ৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ২০২৪ সালের অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত এটি ঝড়কে সামলিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
জানা গেছে, কানাডায় ভারতের সবচেয়ে বড় রফতানির মধ্যে রয়েছে ওষুধ, ইস্পাত ও লোহার পণ্য এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। অপরদিকে নয়াদিল্লির কানাডিয়ান সারের ওপর নির্ভরতা রয়েছে।
শ্রীবাস্তব এএফপিকে বলেন, আমি অবিলম্বে বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। উভয় দেশের কোম্পানিই তাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে রফতানি ও আমদানি করে। ভারত বা কানাডা কেউ যদি কিছু অংশে বাণিজ্য নিষিদ্ধ না করে, তা হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তবে কানাডার পক্ষে দাঁড়িয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে কানাডার অভিযোগকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। আমরা চেয়েছিলাম ভারত সরকার এই নিয়ে কানাডার তদন্তকে সাহায্য করুক। তবে ভারত অন্য এক পথ বেছে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শিখ নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রেও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে ওয়াশিংটন। পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত এক ভারতীয়কে গত বছর প্রথমে বেলজিয়ামের পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে তাকে মার্কিন আদালতে পেশ করা হয়।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ বিষয়েও প্রশ্ন করা হয়। জবাবে মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত একটি ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করতে ১৫ অক্টোবর দেশটির একটি টিম ওয়াশিংটন সফর করছে। ভারতীয় তদন্ত টিমের ওয়াশিংটন সফরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি। তিনি বলেন, তারা (ভারত) এখানে একটি তদন্ত কমিটি পাঠিয়েছে, বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে বলেই আমরা মনে করছি।