প্রচলিত আইনে সদ্য পদত্যাগী তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসানের শাস্তি দাবি করেছেন বিশিষ্টজনরা। ‘নারীবিদ্বেষী, কুরুচিপূর্ণ, অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ায় ডা. মুরাদকে গ্রেফতারের পক্ষেও মত দিয়েছেন তারা।
দলীয় রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সংস্কৃতি ও শপথ ভঙ্গ করায় দল থেকেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সংসদ সদস্য পদ বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রকেই মামলা করতে হবে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমরা শুরু থেকেই কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আসছি। বক্তব্যসহ প্রতিক্রিয়াও দিয়েছি। এখন তিনি (ডা. মুরাদ) পদত্যাগ করেছেন।
এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তার অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে। তিনি বলেন, এখন রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে কথা বলাটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। মুরাদ সাহেবের ঘটনাটি আকস্মিক নয়। আগের ধারাবাহিকতায় এটা হয়েছে। আমি মনে করি, নাগরিক হিসাবে বিচার করা, বিচার পাওয়ার অধিকার সবার সমান।
আমাদের যদি আইনের আওতায় থেকে কথা বলতে হয়-তাহলে মুরাদ সাহেব কেন নয়? সাধারণ মানুষের বিচার হলে-তার কেন বিচার হবে না? শুধু পদত্যাগই যথেষ্ট নয়, অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। কেউ যদি অন্যায় অপরাধ করে, তার শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, যারা রাজনীতি করেন তাদের শিষ্টাচার মানতে হবে। রাজনৈতিক কৃষ্টি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসরণ করার জন্য বেশি দূর এগোনোর দরকার নেই। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকেই সব নিতে পারি।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত আছেন তাদের উচিত বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো পড়া। তার বক্তব্যসহ জীবনাচার অনুসরণ করা। সবাই যদি বঙ্গবন্ধুর লেখা বই পড়েন তাহলে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা পাবেন। সঠিক আলো পাবেন; যে আলোয় সমাজ আলোকিত হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মুরাদের বিচার তো করতেই হবে। পদত্যাগ তো আইন অনুযায়ী বিচার নয়। আমি বলতে চাই, তার এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্র বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে।
সে যে ভাষায় কথা বলেছে, সেটা ভাইরাল হয়েছে। তার কুরুচিপূর্ণ শব্দগুলো দেশ-বিদেশের মানুষ শুনেছেন। এতে কিশোর-কিশোরীসহ অসংখ্য মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আমি বলব, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ কি করে এত থার্ডক্লাস লোককে মন্ত্রী বানাল? দলীয় লোকজন কি এ ইতরের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেনি আগে। শুধু মুরাদ নয়, অশ্লীল কথাবার্তা অনেকেই বলছেন। তাদের কেউ এমপি, কেউ মন্ত্রী। তাদেরও বাদ দেওয়া উচিত।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, সমাজের মানুষ এখন সচেতন। তার এমন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ-ঘৃণা জানাচ্ছেন। সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে এখন বিচারের দাবিও উঠছে। মানুষ চিন্তাশীল বলেই প্রতিবাদ হচ্ছে।
আমি মনে করি, এমন বক্তব্য বড় ধরনের অপরাধ। এ অপরাধের জন্য যিনি প্রাথমিকভাবে শাস্তি পেলেন, সেটা সরকারি পর্যায়ে থেকে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। কারণ পরবর্তী সময়ে অন্যরা সচেতন হবেন। শ্রদ্ধাশীল হবেন। মনে রাখতে হবে, যা খুশি তা বলে পার পাওয়া যায় না, যাবেও না।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, মুরাদ সাহেবের বক্তব্য সংবিধান অবমাননা। তাকে আইনের আওতায় আনা জরুরি। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্য, যেমন-সংসদ, রাজনৈতিক দল। সেখানে তার বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়-তা দেখার বিষয়।
তিনি বলেন-সাধারণ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তাসহ সবার ক্ষেত্রেই আইন সমান। তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, শুনিনি।
আমরা দেখি সাধারণ মানুষ-ফেসবুক স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার হলে তাদের রাতে তুলে নেওয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে অনেককে বহুদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে। এরকম অজস্র ঘটনা আছে। এ আইন সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে-আর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।
অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পদত্যাগ, শাস্তি কিংবা বিচার এক নয়। প্রতিমন্ত্রীর সেই অবমাননাকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে অবশ্যই সবার প্রতিবাদ করা উচিত। প্রতিবাদ হচ্ছেও। কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের সব নারীর সম্মানহানি করেছেন।
এরজন্য তাকে দেশের সব নারীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমাও চাইতে হবে। আমি আইনের মানুষ, স্পষ্ট বলতে চাই-পদত্যাগের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
তিনি এক নায়িকার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভিকটিম যদি মামলা করেন, আমরা পাশে থাকব। সরকারও এমন অপরাধের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে, নির্দেশ দিতে পারে।
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ বলেন, তিনি (মুরাদ) পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। এটাই কি শেষ? তার বক্তব্যে নারীদের প্রতি অবমাননা এবং বর্ণবৈষম্যের বিষয়টি চরমভাবে উঠে এসেছে। আমি বলতে চাই, তিনি যতই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হন-এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে হবে। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।