মোঃ মামুন হোসেন : একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো সৎ, বিচক্ষণ ও জনবান্ধব নেতৃত্ব। নেতৃত্ব মানেই শুধু ক্ষমতার আসনে বসা নয়, বরং জনগণের জন্য আত্মনিবেদন, সেবার মানসিকতা ও নৈতিক দৃঢ়তা। অথচ দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নেতৃত্বের আসনে বসছেন চাঁদাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি, যারা জনসেবা নয়, নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন। এ এক গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট, যা জাতির ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
চাঁদাবাজরা সাধারণত ক্ষমতা ও প্রভাবকে পুঁজি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেন। তারা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করে। বাজার, পরিবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা চাঁদাবাজির থাবা বিস্তার করে। তারা প্রশাসন ও পুলিশের একটি অংশকে ম্যানেজ করে একটি অদৃশ্য সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে সাধারণ মানুষ চুপ থাকতে বাধ্য হয়। এই নেতৃত্ব একদিকে যেমন রাষ্ট্রের রাজস্ব খাতে ভাটা ফেলে, অন্যদিকে জনমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। একজন প্রকৃত নেতার মূল পরিচয় হচ্ছে তিনি জনগণের পাশে থাকেন, দুর্দিনে সহমর্মিতা দেখান এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু যখন নেতৃত্ব চাঁদাবাজদের হাতে চলে যায়, তখন সেই নেতৃত্ব জনসেবার পরিবর্তে ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ারে পরিণত হয়। তারা জনপ্রতিনিধির আসনে বসে নিজের এলাকাকে লুণ্ঠনের ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব খাতে দুর্নীতি, বাণিজ্য ও দালালতন্ত্র গেড়ে বসে। চাঁদাবাজ নেতাদের উত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় ভূমিকা আছে। অনেক সময় দলের প্রভাবশালী নেতারা চাঁদাবাজদের ব্যবহার করে রাজপথে আধিপত্য বজায় রাখেন। তারা মনে করেন, এইসব ‘দক্ষ’ ক্যাডার নেতারা জনসভা জমাতে, মিছিল-মিটিংয়ে লোক জোগাড় করতে এবং বিরোধীদের দমন করতে কাজে লাগে। ফলে, অপরাধী কিংবা চাঁদাবাজদের পুনর্বাসন করা হয় দলে, তাদের প্রার্থিতা দেয়া হয় নির্বাচনে। এ এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক চর্চা, যা সমাজে অপরাধের সংস্কৃতি গড়ে তোলে।আমরা এমন নেতৃত্ব চাই যারা হবে দূরদর্শী, নীতিবান এবং জনগণের স্বার্থে আপসহীন। এমন জনসেবক নেতৃত্ব সমাজে পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা জোগায়। তারা দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান নেয়, আইন মেনে চলে এবং প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে উৎসাহী থাকে। জনসেবক নেতারা রাস্তা তৈরি করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানোন্নয়ন ঘটায়, স্বাস্থ্যখাতকে উন্নত করে এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব দেন। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। চাঁদাবাজদের নেতৃত্বে আসার অন্যতম কারণ হলো জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব ও ভ্রান্ত রাজনৈতিক আনুগত্য। অনেক সময় ভোটাররা ব্যক্তি নয়, প্রতীকের ভিত্তিতে ভোট দেন। ফলে একজন সৎ, জনবান্ধব প্রার্থী দলীয় প্রতীকের অভাবে পিছিয়ে পড়েন। আবার কেউ কেউ স্বল্পকালীন সুবিধার আশায় দুর্নীতিবাজদের ভোট দেন। এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। জনগণকেই সৎ নেতৃত্বকে খুঁজে বের করতে হবে, এবং লোভ-ভয় উপেক্ষা করে ভোট দিতে হবে জনসেবকদের। চাঁদাবাজ নেতাদের মুখোশ উন্মোচনে সাংবাদিকতা ও নাগরিক সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যদি চাঁদাবাজদের অপকর্ম জনসম্মুখে তুলে ধরে, তবে তা জনমত গঠনে সহায়তা করে। নাগরিক সমাজ যদি সোচ্চার থাকে, তাহলে দলগুলোও বাধ্য হয় সৎ নেতৃত্ব বেছে নিতে। সামাজিক আন্দোলন ও গণসচেতনতা গড়ে তুলে এই দুর্বৃত্ত নেতৃত্বের প্রবণতা রুখে দেয়া সম্ভব। চাঁদাবাজি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বহু ক্ষেত্রেই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রেহাই পেয়ে যায়। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এতে করে চাঁদাবাজরা যেমন দমন হবে, তেমনি ভবিষ্যতে কেউ এই পথে হাঁটার সাহস পাবে না।যদি আমরা এখনই নেতৃত্বে জনসেবক বাছাই না করি, তাহলে সামনে দুর্নীতির ক্যান্সার সমাজের প্রতিটি শিরায় ছড়িয়ে পড়বে। তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে, মেধা পেছনে পড়ে থাকবে, সন্ত্রাস ও অনৈতিকতা বাড়বে। দেশের উন্নয়ন হবে শুধুই কাগজে কলমে—বাস্তবে জনগণের জীবনমান নেমে যাবে আরও নিচে। তাই এখনই সময় আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর।নেতৃত্বে চাঁদাবাজ নয়, চাই সৎ, ন্যায়বান, সাহসী ও জনসেবক মানুষ। যিনি হবেন গণমানুষের কণ্ঠস্বর, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেবেন এবং জনগণের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করবেন। এমন নেতৃত্বই পারে জাতিকে উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে নিতে। এখন আমাদের প্রত্যেককেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি চাঁদাবাজ ও লুটেরা নেতৃত্বে দেশকে ছেড়ে দেব, নাকি প্রকৃত জনসেবকদের হাতে তুলে দেব ভবিষ্যতের হাল।
সময় এসেছে—দেশ গড়ার নেতৃত্ব হোক জনতার, চাঁদাবাজদের নয়।