ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে জ্বরের সিরাপ পানে দুই সহোদরের মৃত্যুর ঘটনায় নির্দিষ্ট ব্যাচের সিরাপ বাজার থেকে তুলে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ সিরাপ শনাক্তে প্রত্যেক জেলায় পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদশনের জন্যও বলা হয়েছে বিভাগীয় ও জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি ওই ব্যাচের (নং ৩২১১৩১২১) সিরাপ বিক্রি না করতে ওষুধ বিক্রেতাদের অনুরোধ করেছে। সংগঠনের সহসভাপতি দ্বীন আলী বলেন, সেন্ট্রালি আমাদেরকে ডিসি অফিস থেকে কোনো চিঠি দেয়নি বলে আমরাও সদস্যদের জন্য কেন্দ্র থেকে কোনো চিঠি দিতে পারছি না, সার্কুলারটা ইস্যু করছি না। কিন্তু আমরা মৌখিকভাবে বলছি সবাইকে। আমরা অলরেডি ব্রাঞ্চগুলোকে বলেছি যাতে এ ওষুধগুলো বিক্রি না হয়। যে জেলাগুলোয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুপাররা আমাদের জানিয়েছেন, সেখানেই আমাদের সদস্যরা পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির সদস্যরা রোববার দুপুরে দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে দুই শিশুর স্বজনদের সাথে কথা বলেন। পরে কমিটির প্রধান অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আকিব হোসেন বলেন, ওষুধটিতে কী এমন উপাদান ছিল-যেটি খাওয়ার ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে রিঅ্যাকশন করল-এটি আসলে রহস্যজনক বিষয়। এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে হয়তো সময় লাগবে।
ডা. আকিব আরও বলেন, যে সিরাপটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। একই ওষুধের অন্যান্য ব্যাচের ওষুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। শিশুদের স্বজনরা জানিয়েছে, ওষুধ খাওয়ানোর পরই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
ডা. আকিবের সঙ্গে ছিলেন অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাইম গোলজার, মো. শফিকুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মো. নাইম গোলজার, মো. রাজিবুল হাবিব ও পরিদর্শক নাহিয়ান আলম। তারা দুই শিশুর মা লিমা বেগম, চাচা উজ্জ্বল মিয়া ও দাদি লিলুফা বেগমের সাক্ষ্য নেন।
১০ মার্চ রাতে নাপা সিরাপ পান করে ইয়াছিন খান (৭) ও মোরসালিন খান (৫) মারা যায়। তাদের বাবা ইটভাটা শ্রমিক ইসমাঈল হোসেন ওরফে সুজন খান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তিনি সিলেটে একটি ইটভাটায় কাজ করেন। ছেলেদের খবর পেয়ে রাতে বাড়িতে আসেন। সুজন খান যুগান্তরকে বলেন, আমার দুটি ছেলেই ছিল আমার স্বপ্ন। এখন আমার বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন রইল না।
লিমা বেগম জানান, আশুগঞ্জ হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন দেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে বাচ্চাদের স্টমাক ওয়াশের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ১০টাকার টিকিট কাটার পর ইমার্জেন্সি রুমে শার্ট প্যান্ট পরে বসে থাকা ডাক্তার বলেন, আপনার বাচ্চারা সুস্থ আছে বাড়িতে চলে যান। তারপরও আমি নিজে ডাক্তারের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছি, আমার ছেলেদের একটিবার দেখার জন্য। তিনি দেখেননি। আমাকে বাচ্চাদের নিয়ে চলে যেতে বলেন। এরপর আমি চলে আসি। পথে আমার ছোট ছেলে মারা যায় এবং বড় ছেলে মারা যায় বাড়িতে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে কতর্ব্যরত চিকিৎসক মো. সোলাইমান বলেন, আমার সঙ্গে বাচ্চার মা-বাবা বা কারওর সঙ্গে কথা হয়নি। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, সদর হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য আছে তবে তা আগের তুলনায় কম। আমরা চেষ্টা করছি দালালমুক্ত করতে। আশুগঞ্জে দুই বাচ্চা সত্যি কী কারণে মারা গেছে, তা ভিসেরা রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটিতে আছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহিউদ্দিন (প্রধান) এবং কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসাইন ও ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. রফিক-উস-ছালেহীন (সদস্য)। তারা রোববার বিকাল পর্যন্ত তদন্ত করতে আশুগঞ্জে ঘটনাস্থলে আসেননি। এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মহিউদ্দিন মোবাইল ফোনে বলেন, দুইদিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট জমা দিতে পারব। কবে নাগাদ তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে আসতে পারেন, তা জানাননি তিনি।
ওই ব্যাচ নম্বরের কোনো সিরাপ কারও কাছে থাকলে দ্রুত নিকটস্থ কেমিস্ট অফিসকে জানাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুরোধ জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নাপা সিরাপের ব্যাচ নং ২১১৩১২১ মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল না। উৎপাদনের তারিখ লেখা ছিল ১২/২০২১ এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ১১/২০২৩।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি বড় কোম্পানি নির্দিষ্ট একটি ব্যাচে ২০ থেকে ৫০ হাজার সিরাপ উৎপাদন করে থাকে। নাপা সিরাপের বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুসন্ধান করছে। তাই এখনই আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। অধিদপ্তরের অনুসন্ধান শেষে যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে, তারপর আমরা আমাদের ব্যাখ্যা জানাব।