তোমার বদান্যতার মর্ম বুঝতে চাইলাম। নিজের ভেতর থেকে অনুসন্ধান শুরু করলাম। আমার সবকিছুই তো জারি আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারায়। সেখানেই দেখতে পেলাম বিরতিহীন অনুগ্রহ ও করুণায় তোমার প্রকাশ!
একটি মিনিট চলে গেলো। প্রায় ১৮ বার শ্বাস নিয়ে থাকবো। উচিত ছিলো কমপক্ষে ১৮ বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
একটি ঘন্টা চলে গেলো। প্রায় ১ হাজার ৮০ বার শ্বাস নিয়ে থাকবো। উচিত ছিলো ১ হাজার ৮০ বার শুকরিয়া আদায়।
একটি দিন চলে গেলো।প্রায় ২৫ হাজার ৯২০ বার শ্বাস নিয়ে থাকবো। উচিত ছিলো ২৫ হাজার ৯২০ বার তোমাকে স্মরণ করা।
একটি শ্বাসের পেছনে দেহে এবং দেহের বাইরে তোমার যে আয়োজন, তুমি চাইলেই তা বন্ধ করে দিতে পারতে। এ শ্বাস গ্রহণের মধ্যে মানুষে মানুষে রয়েছে তারতম্য।
একেবারে ছোট্ট শিশুরা শ্বাস নেয় সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। প্রতি মিনিটে তারা শ্বাস নেয় ৩০-৬০ বার। একটু বড় বাচ্চারা মিনিটে ২০-৩০ বার শ্বাস নেয়। কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্করা মিনিটে নেয় ১২-২০ বার ।
সক্রিয় শারীরিক তৎপরতা ও বিশ্রামকালে আমাদের শ্বাসগ্রহণে দেখা যায় ভিন্নতা। বিশ্রামে একজন বয়স্ক মানুষ দিনে শ্বাস নিতে পারে ১৭ থেকে ত্রিশ হাজার বার। কাজের মধ্যে প্রতিদিন শ্বাস গ্রহণের পরিমাণ ৫০ হাজার বারে পৌঁছাতে পারে।
প্রতিনিয়ত শ্বাসগ্রহণের পাশাপাশি শরীরে ঘটছে কতো ঘটনা। প্রতি মিনিটে দেহে মারা যাচ্ছে ৩০ লাখ কোষ, জন্ম নিচ্ছে আরো ত্রিশ লাখ। একেক কোষ একেক সেল বা কক্ষ। জীবদেহের কার্যগত ও গঠনগত একক হচ্ছে কোষ। অর্ধভেদ্য বা প্রভেদক ভেদ্য পর্দা দ্বারা সে বেষ্টিত, প্রোটোপ্লাজম দ্বারা নির্মিত, সে স্বপ্রজননশীল।
কোষগুলোর আবার আছে গঠনগত পার্থক্য, আকৃতিগত ভিন্নতা এবং কাজেরও স্বাতন্ত্র। সবার কাজ এক রকম নয়। চরিত্রও আলাদা। প্রতি সেকেন্ডে ঘটছে ৫০ হাজার কোষের মৃত্যু আর ৫০ হাজার নতুন কোষের জন্ম।
স্নায়ুগুলোর মাধ্যমে দেহ থেকে মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্ক থেকে দেহে সংকেত আসা যাওয়া করছে প্রত্যহ, সর্বোচ্চ প্রতি ঘন্টায় ২৬৮ মাইল গতিতে।
প্রায় ৩৭ লক্ষ কোটি কোষ আছে মানব শরীরে। প্রতিটি কোষেই আছে জীবন। এর মানে শুধু কোষকেন্দ্রিক প্রায় ৩৭ লাখ কোটি জীবন জারি আছে আমার সক্রিয় থাকার প্রয়োজনে!
কতো রহস্যময় কাজ রয়েছে কোষবিন্যাসে! নিতান্তই ক্ষুদ্র এসব কোষ! একটি সূচের মাথায় মানবদেহের প্রায় দশ হাজার কোষ স্থাপন করা যায়। কিন্তু এসব কোষের আছে শাখা-প্রশাখা।
একটি কোষে থাকে প্রধানত তিনটি অংশ। কোষঝিল্লি, সাইটোপ্লাজম এবং নিউক্লিয়াস। এগুলোকে একত্রে প্রোটোপ্লাজম বলতে পারি।
এই প্রোটোপ্লাজম হচ্ছে জীবের জীবনের ভিত্তি। এটি যে কোষে থাকে না, সে মরে যায়। জীবিত কোষ মানেই একেকটা প্রোটোপ্লাজম। যার আছে চেতনা ও বংশবিস্তার।
এসব কোষের উপরই নির্ভর করে জীবদেহের সকল কাজ! মানে আমার প্রতিটি কাজের পেছনে কাজ করছে কোটি কোটি জীবন।
শরীরে সক্রিয় আছে রক্তপ্রবাহ, একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের রক্তের শিরা-উপশিরাগুলোর সম্মিলিত দৈর্ঘ হবে ১ লাখ মাইল!রক্ত নামের অস্বচ্ছ লাল তরল পদার্থটি শরীরের জ্বালানি এবং অভ্যন্তরীণ এক পরিবহন মাধ্যম।শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করছে, দেহের অন্য সব তরল পদার্থে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে, দেহ রোগ্রক্রান্ত হলে জীবাণুর বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে প্রথম প্রতিরোধ।
তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, শিরা বা ধমনীর মধ্য দিয়ে দেহের প্রতিটি টিস্যুতে খাবার ও অক্সিজেন পৌছে দেয়া । টিস্যু বা কোষগুচ্ছসমূহের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং ক্ষয়রোধের জন্যে এ খাবার ও অক্সিজেন অপরিহার্য।
এর পাশাপাশি রক্ত টিস্যুর বর্জ্যগুলো বের করে দিচ্ছে,কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে বয়ে নিচ্ছে ফুসফুসে; দেহের বাইরে বের করে দিতে, বাড়তি উপাদানগুলোকে বয়ে নিচ্ছে কিডনিতে, অবাঞ্চিত অংশ সেখান থেকে দেহের বাইরে চলে যাওয়া নিশ্চিত হবে।
দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন রক্তের মাধ্যমেই পৌঁছে যায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, নিশ্চিত করে ওই অঙ্গের কর্মক্ষমতাকে।
রক্তে রয়েছে নানা উপাদান। প্রত্যেক উপাদানের কাজ বিচিত্র।এক ফোঁটা রক্তে থাকে ২৫০ মিলিয়ন বা ২৫ কোটি লোহিতকণিকা, চার লাখ শ্বেতকণিকা ও ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি প্লাটিলেট তথা অণুচক্রিকা, যা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য জরুরী। এ কণিকগুলো ডুবে থাকে তরল প্লাজমার মধ্যে। প্লাজমা রক্তের অনুজ্জ্বল হলদে জলীয় অংশ। রক্তের প্রধান অংশ এই প্লাজমা।
লোহিতকণিকা আপন কাজ করছে। সে ফুসফুস থেকে হৃৎপিণ্ড হয়ে সারা দেহে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় এবং সারা দেহের কোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফুসফুসে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
শ্বেতকণিকা জানে তার কাজ। সে শরীরে হানাদার জীবাণুর সাথে লড়াই করে, তাকে ধ্বংস করে। প্লাটিলেট জানে আপন কাজ। রক্তকে জমাট রাখছে সে। নতুবা এর ক্ষরণ হতো দ্রুতই। দেহ জখমী হলে সে জখমস্থানে রক্তকে জমাট বাঁধতে সহায়তা করছে।
প্লাজমা এসব রক্তকণিকাগুলোকে সারা দেহে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। পাশাপাশি রাসায়নিক পদার্থ ও পুষ্টি সরবরাহ করে দেহের বিভিন্ন অংশে।
একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানব দেহে ২০ থেকে ৩০ ট্রিলিয়ন লোহিত রক্তকণিকা কাজ করে। এরা জন্ম নেয় এবং ৪ মাস বাঁচে। এসব রক্তকণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন নামের রঞ্জক পদার্থ, যা দেহের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে।এই কণিকার পরিমান কমে গেলে জন্ম নেবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা। যা শরীরকে করে দিতে পারে অচল, ডেকে আনতে পারে মৃত্যুও!
অনুরোপ সক্রিয় আছে শ্বেত রক্ত কণিকা। যাদের সংখ্যা ২৫০ কোটি । এরা জন্ম নেয় এবং মাত্র ১২ ঘন্টা বাঁচে। রক্তে শ্বেতকণিকা কম থাকলে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে।
আর এ কণিকা মাত্রার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে ক্যান্সারের প্রবণতা বেড়ে যাবে। একটি সুস্থ্ দেহে ঘন্টায় ৭ মাইল বেগে চলাচল করে রক্ত। রক্তের এ সঞ্চালন যদি ৫ মিনিট বন্ধ থাকে, মারা যায় মানুষ।
একজন স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান মানুষের দেহে জাগ্রত অবস্থায় ২৪ ঘন্টায় ৭,৫০০ লিটার রক্ত পাম্প হয়, হৃৎপিণ্ড ১,৩০,৬৮০ বার স্পন্দিত হয়, তার মাথার মগজের ৭০ লক্ষ কোষ কোন না কোন কাজ করে।
তার মধ্যে প্রত্যহ জন্ম নিচ্ছে অনুভূতি। স্নায়ুতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অনুভূতি ঘন্টায় ২০০ মাইল বেগে প্রবাহিত হয়। দেহে ও মনে অনুভূতি আসলে তা মস্তিষ্কে পৌছাতে তার সময় লাগে মাত্র ০.১ সেকেন্ড।
দেহের দুটি কিডনি প্রতি মিনিটে ১.৩ লিটার রক্ত ছাঁকছে এবং এর ফলাফল প্রস্রাব আকারে বের হয়। সেগুলোর মধ্যে কোথাও না কোথাও জটিলতা দেখা দিতে পারতো যে কোনো মুহূর্তে!
আমার দেহের মোট ওজনের মাত্র ১ শতাংশের সম পরিমাণ পানির ঘাটতি হলেই পিপাসা অনুভব করি। সেই ঘাটতি যদি মোট ওজনের ৫ শতাংশের সমপরিমাণে চলে যায়, অজ্ঞান হয়ে যাবো, আর ১০ শতাংশের সমান হলে পানি শুন্যতায় আমি মারা যেতাম।
একটু ভাবলে অনেক কারণ সামনে আসবে, যা আমার অস্তিত্বকে বিপন্ন করতো যে কোন মুহূর্তে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি তোমার ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু তোমাকে স্মরণ করলাম কই?
আমি একটি বারও নিজের প্রয়োজন ছাড়া তোমাকে ডাকিনি। জ্ঞাপন করিনি শুকরিয়া। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে শ্বাস নিতে দিচ্ছো। রক্তপ্রবাহ জারি রাখছো। এসবের সকল উপাদান সরবরাহ করে চলছো অবিরল।
তোমার দানশীল গুণের প্রকাশ আমার প্রতিটি স্পন্দনে। শুধু কোষের ক্রিয়া, শ্বাসের ধারা কিংবা রক্তসঞ্চালনের কৃতজ্ঞতা আদায়েই একজীবন যথেষ্ট নয়। তাহলে কথার, চলার, শোনার, বুঝার, ঘুমের, জাগরণের, খাদ্যের, পানীয়ের, সংসারের, সন্ততির, সুস্থতার এবং আরো অগণিত অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় কি কেউ করতে পারে? কোনো জীবনে?
কেউই পারে না। তবু তুমি দান করে চলো। সবাইকে। নিরন্তর। বিনিময়হীন। স্বার্থ ও শর্তহীন। নিখিলব্যাপী এমনতরো করুণাধারা ঐশ্বরিক না হয়ে পারে?
তোমার সেই দানশীলতা তোমার প্রমাণ। আমার বেঁচে থাকায় তোমার প্রদর্শনী সারাক্ষণ চলমান। কিন্তু আমি তো তোমাকে বুঝতে অলীক যুক্তির পেছনে হাঁটি।
কতোটা দৌড় যুক্তির? যুক্তিশীল মস্তিস্কে তোমার যে লীলা, সেটাই আয়ত্ত করতে যুক্তির জীবন ফুরিয়ে যায়! তুমি যুক্তির অধিক। কেননা যুক্তির অস্তিত্ব তোমার সৃজনের একটি প্রকাশ! এটি মস্তিস্কের সাজানো ধারাপাত। মানবমেধার অধিকে সে যেতে পারে না।
কিন্তু তুমি তো সকল মেধার উর্ধে। কোন মেধা তোমাকে আওতায় আনবে, যেখানে মেধা নিজেই তোমার করুণার ভিক্ষুক? তোমার অনুদান ছাড়া মস্তিস্ক একটি মুহূর্তও সচল থাকতে পারে না!
যদি শুধু অক্সিজেন বন্ধ হয়ে যায়, দশ মিনিটেই মস্তিস্ক অকেজো হয়ে যাবে! আমার মস্তিষ্ক বুঝে জীবনের আয়োজন। কিন্তু আয়োজক তোমাকে বুঝলো কি? বুঝছে কি?