ছোট বেলা থেকে বেড়ে উঠা এক সাথে। এক সাথেই ছিল চলাফেরা, খেলাধুলা। না ফেরার দেশে চলেও গেলেন এক সাথে। এই শোক মানতে পারছে না পরিবারের সদস্যরা। শোকের সেই ছায়া পড়েছে স্বজন-প্রতিবেশী ও বন্ধুদের মাঝে।
শীতলক্ষ্যার নবীগঞ্জ এলাকায় ইঞ্জিন চালিত নৌকা ডুবিতে ৩ বন্ধুর মৃত্যুর ঘটনায় শনিবার (১৫ অক্টেবর) নগরীর খাঁনপুর পরিনত হয়েছে শোকের এলাকায়।
সংবাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য এলাকাটিতে প্রবেশ করতেই পরিচয় হয় নিহতদের বন্ধু নাবিতের সাথে।
নিহত শাওনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময়টিতে নাবিত জানান, ছোট বেলা থেকেই ফুটবল খেলায় আসক্ত ছিলেন রিফাত। ইচ্ছে ছিলো বড় একজন ফুটবলার হওয়া। একই ইচ্ছা বুনছিলেন রিফাতের বন্ধু শাওন। তাদের দুই জনের খেলার সাথী হয়েছে জীম। খুব ভালো ফুটবল খেলতো। খুব হাসি খুশি ছিলো, খেলা এবং বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোই ছিলো তাদের আনন্দের অন্যতম খোরাক।
আক্ষেপ করে বললেন, ‘সেই আনন্দ কেড়ে নিলো ৩ বন্ধুকে’।
গত ১৪ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে নৌকা ডুবে মৃত্যু হয় ২০ বছর বয়সী রিফাত, মো. শাওন ও শাহ পরান ওরফে জীমের। রাত ১২টার মধ্যেই ৩ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ-পুলিশের সদস্যরা।
তাঁর পূর্বের মূহুর্ত গুলো স্মরণ করে নাবিত বলেন, ‘সেদিন দুপুরে ফুটবল খেলেছি। সেখানে খুব সুন্দর ৩টি গোল দিয়েছিল শাওন। খেলা শেষে পরিকল্পনা করা হলো কদম রসূলের মেলায় যাওয়ার। সন্ধ্যায় ১১ বন্ধু মিলে চলেও গেলাম। সেখানে অনেক মজা করেছি আমরা। ফেরার কিছু মূহুর্ত পূর্বে হঠাৎ বৃষ্টি নামলো। কিছু সময় দাঁড়ালাম, বৃষ্টি কমতেই একটি নৌকা রিজার্ব করলাম। সেই নৌকায় মাঝিসহ ১২ জন ছিলাম। ছেড়ে আসার পূর্বে আরও ২ জন উঠালো মাঝি। এতে নৌকার গলুই (নৌকার দুই প্রান্তের সরু অংশ) ডুবু ডুবু করেই অগ্রসর হলো। ঘাট থেকে কিছুদূর যাওয়ার পরই নৌকার সামনের অংশের গলুই ডুবে যায়। ১১জন বন্ধুর মধ্যে ৮জন তীরে উঠতে পারলেও রিফাত, শাওন ও জীম পারেনি তীরে উঠতে। নিখোঁজের কিছু সময় যেতেই মৃত লাশ উদ্ধার করা হয় তাদের।’
নিহত শাওনের বাড়িতে পৌঁছে কাউকে পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেশিরা জানালেন, ‘শাওনের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি সিলেটে গেছে পরিবারের সদস্যরা’।
এরপর যাওয়া হয় শাহপরান ওরফে জীমের বাড়িতে। তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করতেই শাহপরান জীমের ফুপু পারভীন মোস্তফা বিলাপ করে বলেন, ‘এক বছর বয়সে আমার বাজানরে রাইখা মা টা চলে গেছে। ছোট থেইকা আমরা ফুপুরা লালন পালন করছি। কোনদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেই নাই। অনেক আদরের ভাতিজা ছিলো আমাদের, বুকে পিঠে মানুষ করছি। কুকুর-বিড়ারের প্রতি অনেক শখ আছিলো। কিন্তু কে জানতো এভাবে আমাদের কাছে থেকে আল্লায় নিয়ে যাইবো। আমাদের একলা করে চইল্লা গেলো, বইল্লাও গেলো না। এখন রাস্তায় নদীতে কত এক্সিডেন্ট হচ্ছে, কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এটার ব্যবস্থা কেউ নিতাছেন না। গতকাল আমার ভাতিজা যে ট্রলারে আসছিলো এটাতে অতিরিক্ত মানুষ নেয়া হয়েছিলো। এগুলো কেউ দেখে না, এগুলার ব্যবস্থা কেউ নেয় না।’
আর নিহত রিফাতেরে বাবা মো. শাহজাহান বলেন, ছোট বেলা থেকেই খেলার প্রতি অনেক আগ্রহ ছিলো। স্কুলে ভর্তি করায় দিছিলাম কিন্তু পড়াশোনা ঠিকমতো করে নাই। কারণ ওর খেলার প্রতি নেশা ছিলো। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন খেলার ট্রফি আছে এখনো। একপর্যায়ে আমার ফলের ব্যবসার করার জন্য ওরে সাথে নিয়ে যেতাম। রিফাত ফলের দোকানে বসেও ছটফট করতো খেলার জন্য। বিকালে খেলা শেষ করে বাসায় আসে। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকে না, তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায়। সেদিনও আমাদের কাউকে কিছু না বলেই বাসা থেকে বের হয়ে যায় রিফাত। হঠাৎ রাত ১১টায় খবর পাই রিফাত নদীতে ডুবে মারা গেছে’।
বলেই কেধে দিলেন শাহজাহান। বলতে লাগলেন, ‘আর দেখতে পারমু না আমার পোলাডারে। আর খেলার জন্য বকতে পারমু না।’
এদিকে, রিফাত ও জীমের লাশ শনিবার সকাল ১০টায় দাফন করা হয়েছে মাসদাইর কবরস্থানে। এর আগে খানপুর জোড়া টাংকি এলাকায় চিল্ড্রেন পার্ক মাঠে জানাজার নামাজ হয়।
জীমের ফুফা জানান, ‘বহু মানুষ জানায়ায় শরিক হয়েছে। এত মানুষের দোয়া খুব কম, মানুষের ভাগ্যে থাকে।’