চার বছর ঘুরে বিশ্বকাপ এলেই একধারে বিষাদের করুণ বিউগল বাঁজিয়ে বিদায় নেন একঝাঁক তারকা, বিপরীতে নবযৌবনের সুরে আগমনী বার্তা দেন আরেকদল তরুণ। পুরানোর বিদায়ে নতুনের আগমনের সুর বেঁজে উঠছে বিশ্বকাপের ত্রয়োদশ আসরেও। ব্যাট-বল হাতে নবযৌবনের উদ্দীপ্তে বিশ্বমঞ্চে আলোকছটা ছড়ানোর অপেক্ষায় থাকা সেসব তরুণদের দিকে আলোকপাত করা যাক।
তাওহীদ হৃদয় (বাংলাদেশ)
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সেরা সাফল্য এসেছে যুব বিশ্বকাপে। আকবর আলীর নেতৃত্বে বিশে বিশ্ব জয়ের সারথীদের অন্যতম তাওহীদ হৃদয়। প্রতিভা নিয়ে সংশয় ছিল না, অপেক্ষাটা ছিল আরেকটু পরিপক্ব হয়ে ফেরার। তাওহীদ ফিরেছেন একদম ঝকঝকে তকতকে হয়ে। তুমুল উইলোবাজির ঝলক দেখিয়ে জাতীয় দলের জার্সিটাও গায়ে জড়ালেন। শুরু থেকেই সামর্থ্যরে চূড়ান্তটা দেখিয়ে হয়ে উঠেছেন লাল-সবুজের আস্থার প্রতীক।
তিন বছরের ব্যবধানে যুব বিশ্বকাপ পেরিয়ে এবার মূল বিশ্বকাপের মঞ্চে তাওহীদ। পারফরম্যান্স-আশা-ভরসা মিলিয়ে বিশ্বকাপে তাওহীদের ব্যাটেই তারুণ্যের সফলতার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ১৩টি ওয়ানডে খেলে প্রায় পাঁচশ রান করেছেন এই তরুণ। ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৪টি। সবচেয়ে বড় কথা, দলের বিপর্যয়ে পাল্টা আক্রমণে বুক চিতিয়ে উড়িয়েছেন তারুণ্যের নিশান। হার না মানা এই মানসিকতার জোরেই ভারতের মাটিতে আরেকবার বাংলাদেশের ‘হৃদয়’ হতে চান বিশ্বজয়ী তাওহীদ।
শুভমান গিল (ভারত)
অভিজ্ঞতা আর তারকায় ঠাসা দল নিয়ে ঘরের মাঠে শিরোপার লড়াইয়ে নামছে ভারত। এই দলে তারুণ্যের পতাকার ভার বইছেন ইশান কিশান-শ্রেয়াস আইয়ারের মতো তারকারা। তবে সবাইকে ছাপিয়ে আলোটুকু টেনে নিয়েছেন শুভমান গিল। অভিজ্ঞতায় বাকিদের চেয়ে ঢের পিছিয়ে, তবে ব্যাটের বিচ্ছুরণে আলোকিত করে যাচ্ছেন বাইশগজের সবুজ গালিচা। বিশ্বকাপেও তার ব্যাটেই দুর্দান্ত শুরুর অপেক্ষায় ভারত।
জাতীয় দলের হয়ে ইতোমধ্যে ৩১ ওয়ানডেতে দেড় হাজারের অধিক রান করে ফেলছেন শুভমান। ডাবল সেঞ্চুরি আছে একটি, সেঞ্চুরি করেছেন ৬টি, হাফ-সেঞ্চুরির ঘর ছুঁয়েছেন ৯ বার। দ্রুততম ১০০০ রান করাদের তালিকায় আছেন দ্বিতীয় স্থানে। ঘরের মাটিতে ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপে শুভমানের পথচলাটা ‘শুভ’ হওয়ার অপেক্ষা।
নূর আহমেদ (আফগানিস্তান)
আফগানিস্তানকে বলা হয় লেগস্পিনের সূতিকাগার। রশিদ খান নামের এক ঘূর্নি জাদুকর উঠে আসার পর থেকেই ক্রিকেট বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। যে পথ ধরে উঠে এসেছেন আরেক লেগি নূর আহমেদ। যুব বিশ্বকাপে রোশনাই ছড়িয়ে আলোর পাদপ্রদীপে আসেন নূর। বছর আঠারোর এই তরুণ প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছেন আফগানিস্তানের বিশ্বকাপ দলেও। ভারতের মাটিতে রশিদ-মুজিবের সঙ্গে মিলে স্পিনের মায়াজালে ফাঁদ পাততে প্রস্তুত এই লেগি।
ইব্রাহিম জাদরান (আফগানিস্তান)
আফগানিস্তান ব্যাটিং লাইনের শুরুর যে তাণ্ডবটা, সেটার নেতৃত্ব দেন ২১ বছরের তরুণ ইব্রাহিম জাদরান। বয়স দেখে বুঝার উপায় নেই তার উইলোর ধার। ৩৮ ইঞ্চির কাষ্ঠদণ্ডের সাহায্যে মুহূর্তেই সুনামি বইয়ে দিতে পারা ইব্রাহিমই বিশ্বকাপে আফগান ব্যাটিং লাইনের নেতৃত্ব দেবেন। আলোর রোশনাইয়ের অনেকটাই নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন এই তরুণ।
ওয়ানডে খেলেছেন মাত্র ১৯টি। তাতেই রান করে ফেলেছেন ৯ শতাধিক। সমান ৪টি করে আছে সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি। এর মধ্যে আবার এক সিরিজেই পেয়েছেন তিন সেঞ্চুরি। ইব্রাহিমকে নিয়ে আফগানদের প্রত্যাশা তাই আকাশচুম্বী। দেশের মানুষের প্রত্যাশা মেটাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানরা যে জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে, সে তো সবারই জানা। ইব্রাহিমও নিশ্চয়ই বিশ্বমঞ্চে তার সামর্থ্যটুকু জানান দিতে চাইবেন।
ক্যামেরন গ্রিন (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়া দলে তারকার ছড়াছড়ি। অভিজ্ঞ সব তারকার ভীড়ে জ্বলে উঠতে পারেন তরুণ অলরাউন্ডার ক্যামেরন গ্রিন। এবারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার পেস অলরাউন্ডারের দায়িত্বটা সামলাবেন গ্রিন। মিচেল মার্শ তো আছেনই। ব্যাট-বল হাতে সমানভাবে কার্যকর এই তরুণ ভারতের মাটিতে হয়ে উঠতে পারেন অধিনায়কের ট্রাম্প কার্ড। ছোট্ট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান তাই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। ১৬ ওয়ানডে ম্যাচে তিন শতাধিক রানের পাশাপাশি ১২টি উইকেটও ঝুলিতে পুরেছেন গ্রিন।
বাস ডি লিড (নেদারল্যান্ডস)
বিশ্বকাপে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে মূল আসরে সুযোগ পেয়েছে নেদারল্যান্ডস। এবারের বিশ্বকাপে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থাকলে সেটা একমাত্র কমলা জার্সিধারীদের বদৌলতেই। আর এই অঘটনে নেতৃত্ব দিতে পারেন তরুণ অলরাউন্ডার বাস ডি লিড। ব্যাটে-বলে ডাচদের জন্য হয়ে উঠতে পারেন পরিপূর্ণ প্যাকেজ।
ডি লিড দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। জাতীয় দলের হয়ে সীমিত সংস্করণের ৫০ ওভারের ম্যাচে মাত্র ৩০ ম্যাচের ক্যারিয়ার। তাতে ৭ শতাধিক রানের পাশাপাশি উইকেট নিয়েছেন ২৪টি। ১ সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ২ হাফ-সেঞ্চুরি। ডি লিডের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, পরিস্থিতি বুঝে খেলতে পারেন। তাতে তেরঙ্গার ছায়াতলে কমলা উৎসব হলেও হতে পারে।
মার্কো জানসেন (দক্ষিণ আফ্রিকা)
দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ মিশনের দলটা অভিজ্ঞ তারকায় ঠাসাঠাসি। এদের ভিতরে তারুণ্যের পতাকাটা বয়ে নিয়ে চলছেন ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার মার্কো জানসেন। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও দুর্দান্ত করেন ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ।
শেষ দিকে দলের চাহিদা মেটানোর কাজটাও নিপুণ কায়দায় সেরে আসতে পারেন। ভারতের মাটিতে টেম্বা বাভুমার মোক্ষম অস্ত্র হতে পারেন জানসেন। তাতে প্রতিপক্ষ ধরাশয়ী হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিশ্বকাপে উদীয়মান সূর্যের আলো ছড়াতেই এসেছেন এই ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার।
মাথিশা পাথিরানা (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার বোলিং আক্রমণে লাসিথ মালিঙ্গা নেই বহুদিন হলো। অদ্ভূত অ্যাকশনে বোলিংয়ের দৃশ্যটাও আস্তেধীরে বিস্মৃত হতে লাগলো। তবে পুরোপুরিও ধূসর হলো না। মালিঙ্গাকে ফিরিয়ে আনলেন বছর কুড়ির তরুণ মাথিশা পাথিরানা। হুবহু রানআপ থেকে শুরু করে ফলো থ্রু সবকিছুতেই পাথিরানাতে মালিঙ্গাকে খুঁজে পায় লঙ্কানরা। বোলিং আক্রমণে তাদের ভরসা হয়েই জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন ডানহাতি এই পেসার।
ভারতের মাটিতে অধিনায়ক দাসুন শানাকার বোলিং ভান্ডারের অন্যতম অস্ত্র পাথিরানা। ইতোমধ্যে ওয়ানডেতে ৮ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১২ উইকেট। গতির সঙ্গে দুর্দান্ত লাইন-লেংথ; ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপটাই আলোয় রাঙা ভোরে পরিণত করতে চাইবেন এই পেসার। তাতে লাসিথ মালিঙ্গা আরেকবার ফিরে আসলেও আসতে পারেন।