এশিয়ার অনেক দেশ করোনাভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যখন লড়াই করছে, তখন বিশ্বজুড়ে প্রায় থমকে যাওয়া ভ্যাকসিন ডোজ সরবরাহে গতি ফিরতে শুরু করেছে। ফলে আশা জাগছে, টিকাদানের নিম্নহারের গতি আবারও বাড়তে পারে; যা দ্রুত ছড়াতে থাকা ডেল্টার লাগাম টানতেও সহায়তা করতে পারে।
ভ্যাকসিনের অনেক প্রতিশ্রুতি এখনও অপূর্ণ রয়েছে এবং বেশ কিছু দেশে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত রোগী, অক্সিজেন ঘাটতি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবের বিরুদ্ধে লড়াইরত দেশগুলোতে সহায়তায় আরও অনেক কিছু করা দরকার।
এশিয়ায় করোনার ‘নতুন হটস্পটে’ পরিণত হওয়া ইন্দোনেশিয়ায় বৃহস্পতিবার সকালের দিকে মডার্নার ভ্যাকসিনের ১৫ লাখ ডোজ পৌঁছেছে। দেশটিতে গত কয়েকদিন ধরে করোনায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আরও ৩০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছায়। তার আগে জাতিসংঘের নেওয়া উদ্যোগ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে এক কোটি ১৭ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে ইন্দোনেশিয়া; যা গত মার্চ থেকে দেশটিতে পৌঁছেছে।
ইন্দোনেশিয়ায় কোভ্যাক্সের ভ্যাকসিন বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ইউনিসেফের প্রধান সৌম্য কাদানদালে বলেছেন, এটা বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। এটাকে এখন শুধু ইন্দোনেশিয়ার লড়াই মনে হচ্ছে না। এটা ভ্যাকসিন এবং ভ্যারিয়েন্টের প্রতিযোগিতা। আমি আশা করছি, এই দৌড়ে আমরা জয়ী হবো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) অনেকেই বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিনের অসম বণ্টনের সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, বিশ্বের অনেক ধনী দেশ ইতোমধ্যে তাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিকে টিকা দিয়েছে। অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষ এখনও ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের অপেক্ষা করছেন।
চলতি সপ্তাহে দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস ‘বৈশ্বিক ব্যাপক ভ্যাকসিন বিভাজনের’ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণের গতি বাড়ানো দরকার। রেড ক্রসের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আলেক্সান্ডার ম্যাথিউ বলেছেন, এটা লজ্জার বিষয় যা আগে ঘটেনি এবং নিকট ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না।
তিনি বলেছেন, ‘এটা দেরী করার মতো কোনও বিষয় নয়—লোকজনকে ভ্যাকসিন দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ভ্যাকসিন যত দেরীতে আসবে তত বেশি মানুষ মারা যাবে।’
ধীরগতির টিকাদানের কারণে দ্রুত করোনার বিস্তার ঘটতে থাকায় ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া নতুন করে লকডাউনের বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।
করোনাভাইরাস মহামারির প্রাথমিক ধাক্কা মোকাবিলা করে প্রশংসায় ভাসা দক্ষিণ কোরিয়ায়— এখনও ৭০ শতাংশ মানুষ টিকার প্রথম ডোজের অপেক্ষায় করছেন। জুনের শুরুতে মাত্র গণ টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছে থাইল্যান্ড। মহামারিতে মৃত্যু এবং সংক্রমণের নতুন নতুন রেকর্ড দেখা এই দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। থাইল্যান্ডে এই হার মাত্র ৪ শতাংশ।
ম্যাথিউ বলেছেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন অংশে মানুষ তাদের হারানো স্বাধীনতা যেমন— কাজে ফেরা, সিনেমা হল এবং রেস্টুরেন্ট চালুর ব্যাপারে কথা বলছে। কিন্তু বিশ্বের এ অংশটি তা থেকে অনেক দূরে আছে।’
ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আগের তুলনায় অত্যন্ত আগ্রাসী গতিতে গণ টিকাদান শুরু হয়েছে। স্থানীয়ভাবে চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল এই দেশটির প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের এক ডোজ করে পেয়েছেন। প্রথম দিকে তাদের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং থাইল্যান্ডসহ আরও বেশ কিছু দেশের ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার জন্য আরও অনেক ডোজের প্রয়োজন।
ইউনিসেফের সৌম্য কাদানদালে বলেছেন, ভ্যাকসিনের সংখ্যা ও সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মডার্না এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর শেষের আগেই ইন্দোনেশিয়া ২০ কোটি ৮২ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বর্তমানে দেশটিতে দৈনিক ১০ লাখ ডোজ প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি ডোজই এখানে বিশাল ব্যবধান তৈরি করতে পারে। কিন্তু এই অঞ্চলের অনেক দেশ এখনও টিকাদানের ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে যোজন যোজন দূরে পিছিয়ে রয়েছে।
একই সময়ে ভ্যাকসিনের প্রধান আঞ্চলিক উৎপাদনকারী ভারত দেশের মানুষের ভোগান্তির দিকে মনযোগ দিয়ে টিকার রফতানি বন্ধ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ৮ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সহায়তার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এসব ভ্যাকসিন পাঠানো হয়েছে। আগামী বছর বিশ্বজুড়ে আরও ৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সহায়তার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে চলতি বছরে ২০ কোটি ডোজ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
এই অঞ্চলে সম্প্রতি টিকার যে চালান এসেছে তার বেশিরভাগই ছিল আমেরিকান, জাপানের। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১০ লাখ ডোজ করে পাঠিয়েছে জাপান। এছাড়া একই দিন অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে আরও ১৫ লাখ ডোজ পাওয়ার তথ্য জানিয়েছে ভিয়েতনাম।
চলতি মাসেই টিকার ১ কোটি ৬০ লাখ ডোজ ফিলিপাইনে পৌঁছাতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই ৩২ লাখ, জাপানের ১১ লাখ এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ এক লাখ ৩২ হাজার ডোজ পাবে দেশটি। এছাড়া কোভ্যাক্সের মাধ্যমেও ভ্যাকসিন পাবে ফিলিপাইন।
অন্যদিকে, চলতি মাসেই বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ইরান, লাওস, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে এক কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা পাঠাচ্ছে জাপান। চলতি সপ্তাহের নিজেদের বেচে যাওয়া ১ কোটি ৭৭ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন কোভ্যাক্সের কাছে দিচ্ছে কানাডা। ভ্যাকসিন জোট গাভির সমন্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই উদ্যোগে মোট ১০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কানাডা।
গত জুনে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ১৭ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে ফ্রান্স এবং চলতি গ্রীষ্মে আরও লাখ লাখ ডোজ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া ভ্যাকসিন বিশ্বের ৯২টি নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে কোভ্যাক্স।
চলতি সপ্তাহে শুরুর দিকে আফ্রিকান ইউনিয়ন বিশ্ব নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে প্রশ্ন তোলে এই মহাদেশে ভাকসিন পৌঁছাতে আরও কতদিন লাগবে? সংস্থাটি জানায়, এখন পর্যন্ত মাত্র ১ শতাংশ আফ্রিকান টিকার উভয় ডোজ পেয়েছেন। গাভি বলেছে, ভ্যাকসিন সরবরাহে ঘাটতির কারণ কোভ্যাক্সের অন্যতম সরবরাহকারী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট তাদের উৎপাদিত টিকা দেশে ব্যবহার করছে।
সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে গাভি বলেছে, ভ্যাকসিনের সরবরাহ মাত্র ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে এবং তা চলতি বছরে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ২৩ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় প্রায় দেড়শ কোটি ডোজের লক্ষ্যপূরণের পথে রয়েছে। আগামী বছরের শেষের আগেই আরও ৫০০ কোটি ডোজ টিকার দরকার বলে জানিয়েছে গাভি।
রেড ক্রসের ম্যাথিউ বলেছেন, বিশ্বকে টিকা দেওয়া এবং গোপন মজুত এড়ানোর দিকে মনযোগ দেওয়াই ভালো হবে। ভ্যাকসিনের বণ্টন প্রত্যেককে নিরাপদ করবে।