বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে হতে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকছে না বিএনপি। দলটি নিজেরাই অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা সেরেছে।
দলটি মনে করছে, এটি অন্তবর্তী সরকারে পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রদের একক ঘোষণাপত্র। এ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে দায়সারা কাজ হয়েছে। যেখানে বিএনপির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসকে কৌশলে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে দলটির নেতাকর্মীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সম্মুখে লড়াই করেছে; বহু প্রাণ দিয়েছে। বিএনপি সমমনা দল ও শরিকদের নিয়ে নিখুঁতভাবে ঘোষণাপত্র প্রণনয় করতে চায়।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতা ও শরিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে তারা। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা। প্রথমে সরকার এর সঙ্গে যুক্ত না হলেও পরে এ প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানায়। তখন ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি বদল করে সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে সরকার ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা শুরুর কথা বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এই উপদেষ্টা বলেন, ঘোষণাপত্রটি কবে আসবে এবং এর ভেতরে কী কী কন্টেন্ট থাকবে সে বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। বৃহস্পতিবার আশা করি সবাই মিলে একটা সর্বদলীয় বৈঠক হবে। তার আশা ওই বৈঠকে সবাই এ নিয়ে একমত হতে পারবেন। মাহফুজ বলেন, সরকার কীভাবে ঘোষণাপত্রটি জারি করবে সেটা বৈঠকের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে। আশা করি বাংলাদেশের জনগণের ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে তাদের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবি অনুযায়ী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ হয়নি। ঘোষণাপত্র নিয়ে জাতীয় ঐক্যে পৌঁছাতে আজ সর্বদলীয় বৈঠক করবে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সময়ের আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় সভা হবে। যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেবেন। তবে কাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কি না; সেটি সুনির্দিষ্ট করে জানাননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, বিএনপি দলীয়ভাবে অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলমান। আমরা এই বিষয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করছি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাদের মতামতও নেওয়া হবে। এটা করতে সময় লাগবে। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের খসড়া পায়নি জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন উপদেষ্টা আমাদের দলের মহাসচিবের হোয়াটঅ্যাপে খসড়া পাঠিয়েছেন। প্রথমত এটা কোনো অফিসিয়াল প্রক্রিয়া নয়। তবুও আমরা বিষয়টি আমলে নিয়ে আলোচনা করেছি। খসড়ায় অনেক বিষয় বাদ পড়েছে। সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নিজেদের মতো করে প্রস্তুত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্র এত প্রয়োজন ছিল কি? শুরু থেকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নিয়ে এটি করা হয়নি। কারা এগুলো করছে; এসবের নেপথ্যে কারা সাংবাদিকরা খুঁজে দেখুন।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সময়ের আলোকে বলেন, বিএনপি আমাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেছে। তারা নিজেরা জুলাই-আগস্ট ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। এর আগে তারা একটি খসড়া প্রস্তুত করে আমাদের দেখাবে। আমরা সেখানে মতামত দেব। আন্দোলনে যুক্ত সব অংশীজন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে তারা আলোচনা করবেন। গণতন্ত্র মঞ্চের এই সমন্বয়ক বলেন, অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাত্রনেতা ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক মনে হচ্ছে না। এখানে সব দলকে অন্তুর্ভুক্ত করা নিয়ে উদ্যোক্তাদের সিরিয়াসনেস নেই। তারা ঘোষণাপত্রের কোনো খসড়া আমাদের দেয়নি। ছাত্র সমন্বয়কদের মধ্যে সম্প্রতি দম্ভ ও অহমিকার লক্ষণ সম্পষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে হেয় করে কথা বলছে। এগুলো ভালো বার্তা নয়। ঘোষণাপত্রের নাম করে ছাত্রনেতারা যা করছে এতে ঐক্য সৃষ্টি করবে নাকি বিভাজন বাড়বে-এটা সময়েই বলে দেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, ছাত্রনেতারা এখন জামায়াতের স্টাইলে কথাবার্তা বলছে। তারা পুরোপুরি বিএনপিকে ঘায়েল করে, হেয়প্রতিপন্ন করে বত্তব্য দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আন্দোলনের সব কৃতিত্ব ছাত্র ও জামায়াত নিতে চাচ্ছে। এমন হলে কারও জন্যই কল্যাণ কিছু বয়ে আনবে না। আমরা এখন যুগপৎ শরিকদের শক্তিশালী করছি। তাদের নিয়ে অভুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। যেখানে যার যতটুকু অবদান তা উল্লেখ থাকবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, শেখ হাসনিা সরকার পতনের আন্দোলন হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি বহু বছরের নির্যাতন, নিপীড়ন ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিএনপির দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন পরিক্রমা। এখানে বিএনপির আবদান খাটো করার কোনো অবকাশ নেই। এ বিজয়ের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতিত মানুষের বেদনা, পঙ্গু ও গুম হওয়ার অপ্রকাশিত ইতিহাস। সবার ১৬ বছরের রক্ত, শ্রম ও অশ্রু দিয়ে, প্রতিটি পরিবারের ক্ষোভ, ক্রোধ ও অব্যক্ত বিস্ফোরণ বুকে ধারণ করে; চলমান ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনতার আন্দোলনে গত ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ৮৭৫ জন নিহত হয়েছেন বলে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে জানানো হয়। এর মধ্যে ৪২২ জন বিএনপির নেতাকর্মী বলে দাবি করেছেন দলটি। সেপ্টেম্বরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০২৩ সাল পর্যন্ত শহিদ ১ হাজার ৫৫১ জন, গুম ৪২৩ জন (সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ জন), আসামি ৬০ লাখ এবং মামলা দেড় লাখ। এসব কেবল বিএনপির ত্যাগের পরিসংখ্যানই নয়, বরং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে দলটির অবিচল সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন। এ সময় আন্দোলনের কৃতিত্ব নয়, স্বৈরাচার পতন নিশ্চিত করাই বিএনপির লক্ষ্য ছিল।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির সময়ের আলোকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় শহিদ চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদলের সদস্য শহিদ ওয়াসিম আকরামের নাম অন্তর্ভুক্ত না করা চরম বৈষম্যমূলক। শহিদ আবু সাঈদ এবং মীর মুগ্ধের নাম ঠিকই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শহিদ ওয়াসিম ছাত্রদলের নেতা এবং বিএনপির একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ার কারণেই তার নাম পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ঘোষণাপত্রেও একই কাজ করার অপচেষ্টা চলছে। আমরা চাই সবার অবদান ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকুক।