মণ্ডপে মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ, ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ ও উলুধ্বনির মাধ্যমে মহাষষ্ঠীতে মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গাকে বরণ করে নিয়েছেন ভক্তরা। বুধবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের সূচনা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার মহাসপ্তমী পূজা। এদিন সকালে দেবী দুর্গার চক্ষুদান, নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমীবিহীত পূজা হবে।
বুধবার সকালে ষষ্টীপূজার মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ষষ্ঠী তিথিতে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সকালে বিল্ববৃক্ষ বা বেলগাছের নিচে ঘট স্থাপন করে ষোড়শ উপাচারে দেবীর কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহীত পূজা হয়েছে। এ সময় ভক্তরা দেবী দুর্গার চরণে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে প্রার্থনা করেছেন দেশ তথা বিশ্বে অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠার। এরপর সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল পূজা। সন্ধ্যায় মণ্ডপ ও মন্দিরে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে বোধনের মধ্য দিয়ে চলে দক্ষিণায়নে নিদ্রিত দেবীর নিদ্রা ভাঙার বন্দনা।
সনাতনী শাস্ত্র অনুযায়ী, মহাসপ্তমীতে ষোড়শ উপাচারে দেবী দুর্গাকে পূজিত করা হবে। এ ছাড়া চক্ষুদানের পর ভক্তরা আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, স্নানীয়, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে দেবীকে পূজা করবেন। সকাল ৭টা ৫৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের মধ্যে দেবীর মহাসপ্তমী পূজা শেষ করতে হবে। আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৬টা ৫২ মিনিটের মধ্যে মহাষ্টমী পূজা ও ৬টা ৫২ মিনিটে শুরু, এরপরই কুমারী পূজা। আগামী রোববার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে। সারা দেশে ৩১ হাজার ৪৬১ মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২৫২টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমনের সময়ই দুর্গোৎসব। রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা হয় অকালবোধন।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বলেন, সংকল্প ও আরম্ভ এ দুই মিলিয়ে হয় ‘কল্পারম্ভ’। এর মাধ্যমে দেবীর কাছে প্রতিজ্ঞা করা হয়, সমস্ত নিয়ম মেনেই তার পূজার্চনা করা হবে। এ সময় সারা বিশ্বে ‘অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভশক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায়’ দুর্গার চরণে গন্ধ, পুষ্প, অর্ঘ্য ও বাদ্য দিয়ে প্রার্থনা করা হয়। তিনি আরও বলেন, স্বামীর ঘর স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে তার পিতৃগৃহে পদার্পণ করলেন দেবী। এ সফরে তার সঙ্গে আছেন চার সন্তান গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বর্তী এবং কার্তিকের কলা বউ। ষষ্ঠীতে এই সময়টায় দেবী বেলগাছের তলায় ঘুমিয়ে থাকেন। বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীর ঘুম ভাঙানো হয়।
শ্রী শ্রী রমনা কালীমন্দির শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক অপর্ণা রায় দাস বলেন, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মা দুর্গা এবার মর্ত্যে এসেছেন দোলায় চেপে, ফিরবেন ঘোড়ায় চড়ে। প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন দেবীদুর্গা। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত ৫ দিন চলে দুর্গোৎসব।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ভোর থেকেই পূজার আয়োজনের ব্যস্ততা দেখা যায়। দেবীর আরাধনায় ভক্তরা ভিড় করেন সেখানে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দুর্গাপূজাকে ঘিরে এরই মধ্যে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ, আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় র্যাব-বিজিবি ও সেনা সদস্যদের। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক পাহারা। অনেক মণ্ডপে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরে কড়া তল্লাশির মধ্য দিয়ে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া প্রত্যেকটি পূজামণ্ডপে নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
জগন্নাথ হলে পূজার দর্শনার্থীদের জন্য নির্দেশনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলে পূজায় আগত অতিথি ও শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বুধবার জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অফিসে পূজা উদযাপন কমিটির এক সংবাদ সম্মেলন কমিটির সভাপতি ও হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক দেবাশীষ পাল এ সব নির্দেশনা দেন। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দুর্গাপূজার ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে; বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া উপাসনালয়ের মূল বেদীতে ওঠা যাবে না; উপাসনালয়ে সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার দর্শনার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করতে হবে; উপাসনালয় বা হল প্রাঙ্গণে রাষ্ট্র বা ধর্মবিরোধী মন্তব্য করা যাবে না; হল প্রশাসনের যথাযথ অনুমতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের ভবনে বা রুমে প্রবেশ করা যাবে না; হল প্রাঙ্গণে যানবাহন নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও তল্লাশির প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে হবে; পূজা প্রাঙ্গণে সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে; হলের মধ্যে পার্টি স্প্রে, গ্যাস বেলুন, আতশবাজি বহন ও ব্যবহার করা যাবে না; নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলতে হবে; উপাসনালয়ের নির্দিষ্ট প্রণামী বাক্সে বা তথ্যকেন্দ্রে প্রণামী বা অনুদান দেওয়া যাবে; ধূমপান বা এলকোহলজাতীয় দ্রব্য সেবন করা যাবে না এবং হলের ভেতরে অপ্রয়োজনীয় অবস্থান না করে দ্রুততম সময়ে হল ত্যাগ করতে হবে। এ ছাড়া জগন্নাথ হলের আবাসিক-অনাবাসিক সব শিক্ষার্থীকে সার্বক্ষণিক পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছে।