বাংলাদেশের রান পাহাড়ে রীতিমতো চাপা পড়েছে আয়ারল্যান্ড। বড় লক্ষ্য তাড়ায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে আইরিশদের ব্যাটিং লাইনআপ। তাসকিন-এবাদতদের তোপের মুখে ১৫৫ রানের বেশি করতে পারেনি সফরকারীরা। এর ফলে ১৮৩ রানের বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় জয়।
শনিবার (১৮ মার্চ) সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুরুতে ব্যাটিং করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৮ উইকেট হারিয়ে রেকর্ড ৩৩৮ রান সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। যেখানে বড় অবদান রেখেছেন দুই মিডল অর্ডার ব্যাটার সাকিব আল হাসান এবং তৌহিদ হৃদয়। জবাবে ৩০ ওভার ৫ বল খেলে ১৫৫ রান তুলে অলআউট হয়ে গেছে সফরকারীরা।
বাংলাদেশের দেওয়া ৩৩৯ রানের পাহাড়সম টার্গেট তাড়া করতে নেমে ধীরগতির ব্যাটিংয়ে শুরুতেই চাপে পড়ে আয়ারল্যান্ড। দুই আইরিশ ওপেনার স্টিফেন ধোয়েনি ও পল স্টার্লিংকে দুই প্রান্ত থেকেই চেপে ধরেন তাসকিন-মুস্তাফিজরা। প্রথম ছয় ওভারে সফরকারীরা কোনো উইকেট না হারালেও স্কোরবোর্ডে তুলে ২৩ রান। আর তাতে আইরিশদের প্রয়োজনীয় রান রেইট বেড়ে দাঁড়ায় ৭ এর ওপরে।
শুরুর সেই চাপ কমাতে এরপর আক্রমণাত্মক খেলার চেষ্টা করেন দুই আরিশ ওপেনার। কাউন্টার অ্যাটাকে কিছুটা হলেও সাফল্য পেয়েছেন তারা। পাওয়ার প্লের শেষের ৪ ওভারে ২৮ রান তোলে আইরিশরা। তাতে শুরুর পাওয়ার প্লে শেষে বিনা উইকেটে স্কোরবোর্ডে ৫১ রান যোগ করেছে আয়ারল্যান্ড। এরপর আর বেশি দূর এগোতে পারেনি আইরিশদের উদ্বোধনী জুটি। বিপজ্জনক হয়ে উঠার আগেই ধোয়েনিকে সাজঘরে ফেরান সাকিব আল হাসান। এই স্পিনারের করা ১২তম ওভারের দ্বিতীয় বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৩৮ বলে ৩৪ রান করেছেন তিনি।
ধোয়েনি ফেরার পর আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেলেন না পল স্টার্লিং। একটি করে চার ও ছক্কায় ২২ রানে থেমেছেন এই ওপেনার। ১৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলটি খানিকটা শর্ট লেন্থে রেখেছিলেন এবাদত হোসেন। সেটা আগে থেকেই বুঝতে পেরে পুল করতে যান স্টার্লিং কিন্তু বলে বাড়তি বাউন্স থাকায় ঠিকমতো টাইমিং করতে পাররেননি এই ওপেনার। তাতে বল তার ব্যাটের কানা ছুঁয়ে মুশফিকের গ্লাভসে জমা পড়ে। এদিন উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত ছিলেন অভিজ্ঞ মুশফিক।
আগের ওভারে স্টার্লিংকে ফেরানোর পর নিজের পরের ওভাররেই হ্যারি ট্যাক্টরকেও ফেরান এবাদত। ঠিক যেন আগের ওভারের কার্বন কপি! পার্থক্য ছিল শুধু ব্যাটারে, স্টার্লিংয়ের জায়গায় ট্যাক্টর। এবারও ওভারের দ্বিতীয় বলটি শট লেন্থে ছিল তাতে ব্যাটার পুল করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন। সাজঘরে ফেরার আগে ট্যাক্টরের ব্যাট থেকে এসেছে ৮ বলে ৩ রান।
এবাদত পরপর দুই ওভারে দুই উইকেট নেওয়ার পর দুই প্রান্ত থেকেই পেস আক্রমণে যান তামিম। আর বোলিংয়ে ফিরেই অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিলেন তাসকিন। ১৬তম ওভারের তৃতীয় বলে বার্লবির্নিকে সরাসরি বোল্ড করে সাজঘরে ফিরিয়েছেন এই পেসার। তার আগে ৫ রান এসেছে আইরিশ অধিনায়কের ব্যাট থেকে। তাসকিনের এই ওভারের কোনো বল থেকেই রান নিতে পারেনি আইরিশরা, ফলে উইকেট মেইডেইন পান তিনি।
নিজের পরের ওভারে আক্রমণে ফিরে আবারও উইকেটের দেখা পান তাসকিন। এবার তার শিকার টাকার। ওভারের প্রথম বলটি শট লেন্থে ফেলে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে রেখেছিলেন এই পেসার, সেখানে অন সাইডে টেনে খেলতে গিয়ে ইয়াসির রাব্বির হাতে ধরা পড়েন এই উইকেটকিপার ব্যাটার। তার ব্যাট থেকে এসেছে ৬ রান। ওভারের বাকি বল গুলোতেও কোনো রান দেননি তাসকিন, ফলে পরপর দুটি উইকেট মেইডেন পেয়েছেন এই পেসার।
৬০ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ৭৬ রান তুলতেই সাজঘরে টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটার। ১৬ রানের ব্যবধানে ৫ উইকেট হারিয়ে আইরিশরা যখন ধুঁকছে তখন দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলার চেষ্টা করেন জর্জ ডকরেল ও কার্টিস ক্যাম্পার।
ষষ্ঠ উইকেটে এই দুজনে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তবে অসহায় ছিলেন বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণের সামনে। তাদের জুটিতে একশো পার হয় সফরকারীরা। কিন্তু দলীয় রান তিন অঙ স্পর্শ করার পর আর বেশিদূর এগোয়নি এই জুটি। ১৬ রান করা ক্যাম্পারকে ফিরিয়ে ৩৩ রানের এই জুটি ভাঙেন নাসুম আহমেদ।
২৪তম ওভারের চতুর্থ বলটি অফ এবং মিডল স্ট্যাম্পের ওপর রেখে ফুল লেন্থে করেছিলেন নাসুম। বলে সামান্য টার্ন থাকায় ডিফেন্স করতে গিয়ে লাইন মিস করেন ক্যাম্পার। তাতে বল সরাসরি পায়ে আঘাত হানলে নাসুমের আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি এই আইরিশ অলরাউন্ডার। ফলে রিভিও নেন তিনি। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার।
নিজের পরের ওভারে বোলিংয়ে ফিরে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন নাসুম। ওভারের পঞ্চম বলে ১ রান করা গেরেথ ডেলানিকে লেগবিফোরের ফাঁদে ফেলানোর পরের বলেই অ্যান্ড্রি ম্যাকব্রাইনকেও ফিরিয়েছেন এই স্পিনার। মুশফিকের হাতে ক্যাচ দেয়ার আগে রানের খাতা খুলতে পারেননি ম্যাকব্রাইন। ইনিংসে এটা নাসুমের তৃতীয় শিকার।
ব্যাটারদের এমন আসা-যাওয়ার মিছিলেও এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন ডকরেল। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি কেউই। তার ৪৫ রান শুধুই হারের ব্যবধান কমিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ৩০ ওভার ৫ বল খেলে ১৫৫ রান তুলে অলআউট হয়েছে আয়ারল্যান্ড।
এর আগে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ দল। তবে শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি তাদের। ব্যক্তিগত ৩ রানের মাথায় আইরিশ পেসার মার্ক অ্যাডায়ারের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ওপেনার তামিম ইকবাল। এরপর শুরুর সেই চাপ কিছুটা সামলে নেন লিটন দাস এবং নাজমুল হোসেন শান্ত। তবে দলীয় ৪৯ রানের সময় সাজঘরে ফেরেন লিটনও। কার্টিস ক্যাম্ফারের বলে পল স্টার্লিংয়ের হাতে তালুবন্দী হওয়ার আগে তিনি ৩১ বলে ২৬ রান করেছেন।
এরপর দলেকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নেন সাকিব আল হাসান সঙ্গে থাকেন শান্ত। তবে বেশিদূর এই জুটি এগোতে পারেনি। দলীয় ৮১ রানে শান্ত সাজঘরে ফেরেন ব্যক্তিগত ২৫ রান করে। তখনও অপরপ্রান্তে অবিচল ব্যাট হাতে সাকিব। এরপর উইকেটে আসেন অভিষিক্ত তৌহিদ হৃদয়। সাকিবকে নিয়ে গড়েন বড় জুটি। এদিনই সাকিব ওয়ানডেতে নিজের ৭ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
অন্যপ্রান্তে অভিষিক্ত হৃদয়ও দারুণ খেলে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধ শতক। যদিও দুজনের সামনেই সেঞ্চুরির সুযোগ থাকলেও কেউই পারেননি ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছাতে। ৯৩ রানের মাথায় বিদায় নেন সাকিব। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে ইয়র্কার ধরনের ডেলিভারি করেছিলেন গ্রাহাম হিউম। দূর থেকেই খেলার চেষ্টা করলেন সাকিব। তার ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল চলে গেল কিপার লরকান টাকারের হাতে। আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত জানাতেই ড্রেসিং রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন সাকিব।
এই অলরাউন্ডারের বিদায়ের পরই মারমুখী হতে থাকেন হৃদয়। অন্যপ্রান্তে মুশফিুকর রহিম খেলেন টর্নেডো ইনিংস। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকান অভিজ্ঞ এই টাইগার ক্রিকেটার। যদিও শেষ পর্যন্ত অর্ধ শতক তোলার আগেই বিদায় নেন মুশফিক। ২৫ বলে ৪১ রান করে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন এই উইকেটকিপার ব্যাটার।
তখনও ব্যাট হাতে লড়ছিলেন হৃদয়। অবশ্য অভিষেকে সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়েও তা আর পাওয়া হল না। নেহায়েত কপাল মন্দ! সাকিবের মতো নার্ভাস নাইন্টিতে কাটা পড়েন তরুণ এ ব্যাটারও। গ্রাহাম হিউমের করা ৪৬তম ওভাররের পঞ্চম বলটি গুড লেন্থে পড়ে লেগ স্ট্যাম্প বরাবর আসছিল, সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে লফটেট শট খেলতে চেয়েছিলেন হৃদয়। কিন্তু ব্যাটে-বলে কোনো রকম সংযোগই হয়নি, তাতে বল সরাসরি তার উইকেটে আঘাত হানে। শেষপর্যন্ত ৯২ রানে বোল্ড হয়েই থেমে যায় হৃদয়ের ইনিংস, দলের রান তখন ২৯৭।
এরপর দলের হয়ে হাল ধরার চেষ্টা করেন ইয়াসির আলি রাব্বি। যদিও অন্যপ্রান্তে তাসিকন আহমেদ ফিরে যান ১১ রান করে। এরপর রান আউটে কাটা পড়ে রাব্বি ফেরেন ১৭ রান করে। নাসুম আহমেদ অপরাজিত থাকেন ১১ রানে। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩৩৮ রান সংগ্রহ করে তামিম ইকবালের দল । আইরিশদের হয়ে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট সংগ্রহ ইনিংসের সেরা বোলার গ্রাহাম হিউম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩৩৮/৮ (তামিম ৩, লিটন ২৬, শান্ত ২৫, সাকিব ৯৩, হৃদয় ৯২, মুশফিক ৪৪, ইয়াসির ১৭, তাসকিন ১১, নাসুম ১১*, মুস্তাফিজ ১*; অ্যাডায়ার ১০-০-৭৭-১, হিউম ১০-০-৬০-৪, ম্যাকব্রাইন ১০-০-৪৭-১, ক্যাম্পার ৮-০-৫৬-১, ট্যাক্টর ৬-০-৪৫-০, ডেলানি ৬-০-৫০-০)।
আয়ারল্যান্ড: ৩০.৫ ওভারে ১৫৫ (ধোয়েনি ৩৪, স্টার্লিং ২২, বার্লবার্নি ৫, ট্যাক্টর ৩, ক্যাম্পার ১৬, ডকরেল ৪৫, ডেলানি ১, ম্যাকব্রাইন ০, অ্যাডায়ার ১৩, হিউম ২*; মুস্তাফিজ ৬-০-৩১-০, তাসকিন ৬-২-১৫-২, নাসুম ৮-০-৪৩-৩, সাকিব ৪-০-২৩-১, এবাদত ৬.৫-০-৪২-৪)।
ফল: বাংলাদেশ ১৮৩ রানে জয়ী।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তৌহিদ হৃদয়।