ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন বেড়েই চলেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইস্যুতে ভারতীয় একাধিক মিডিয়া ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে।
সর্বশেষ গত সোমবার হিন্দু সংগ্রাম সমিতি নামক ভারতীয় একটি সংগঠনের সমর্থকরা ভারতের আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা করে। হামলার পর মঙ্গলবার সেখানে কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে মঙ্গলবার তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এমন বাস্তবতায় চলতি ডিসেম্বরে দুপক্ষের মধ্যে এফওসি (ফরেন অফিস কনসালটেশন) বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, দেশের সীমান্তে যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি বা অপতৎপরতা রোধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ২৮ নভেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সংগঠনটি সমাবেশের ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলার চেষ্টা চালায় ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ায়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় উগ্রবাদী সংগঠন হিন্দু সংগ্রাম সমিতি। সংগঠনের সদস্যরা ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলা চালায় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে। এ ঘটনায় ভারত সরকার দুঃখ প্রকাশ করলেও এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে যথাযথ তদন্ত দাবি করেছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া চলমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে প্রবেশ ও ভাঙচুরের অভিযোগে মঙ্গলবার ৭ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার পুলিশপ্রধান (সুপারিনটেনডেন্ট) কে কিরণ কুমার। এছাড়া চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ চারজনের মধ্যে তিনজন উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছে। আর ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে কাজ থেকে বিরত করা হয়েছে। তাকে সদর দফতরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। তবে গত ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভুল তথ্য ছড়িয়েই যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে মুক্তি না দিলে সাময়িকভাবে পেট্রাপোল স্থলবন্দর বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। এতেও কাজ না হলে নতুন বছর থেকে স্থলবন্দর পুরোপুরি বন্ধ করে ভারত থেকে আলু ও পেঁয়াজ বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। সোমবার বাংলাদেশের যশোরের বেনাপোল বন্দরের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর পেট্রাপোলে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন রাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী। ভারতের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) সীমান্তে সনাতনী ঐক্যমঞ্চ নামের একটি সংগঠনের বাধার মুখে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি করা পণ্য দেশে নিয়ে আসতে পারছেন না।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সিলেটের জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার অসিত কুমার আচার্য বলেন, জকিগঞ্জ স্টেশন দিয়ে কেবল ভারত থেকে মালামাল আমদানি করা হয়। কোনো পণ্য রফতানি হয় না। সোমবার সকালের দিকে কিছু কমলা বাংলাদেশে এসেছে। পরে ওই পাশের (করিমগঞ্জ) একটি পক্ষের বাধার মুখে আর কোনো পণ্য বাংলাদেশে আসেনি।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ঢাকার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সব স্তরের জনতাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। মঙ্গলবার ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেয় বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি নামের একটি সংগঠন। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দূতাবাস এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ভারতীয় দূতাবাসে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তায় মঙ্গলবার অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দূতাবাসের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও দেখা গেছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তব্যের প্রতিবাদে সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাতে একাত্মতা জানিয়েছিলেন জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরাও। হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় এদিন শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুকে বলেছেন, ‘আজ ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন তছনছ করা হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হিন্দু সংগ্রাম সমিতি নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। (প্রশ্ন করি, এ ঘটনা ‘মুসলিম সংঘর্ষ সমিতি’ নামের কোনো সংগঠন বাংলাদেশে করলে কেমন আক্রমণাত্মক প্রচারণায় মেতে উঠত ভারত?) আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব ভারত সরকারের। তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার নিন্দা জানাই। নিন্দা জানাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার মন্তব্যের। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যা ঘটে, সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের ওপর, এর জন্য বরং উল্টো ভারতের (এবং মমতার) লজ্জিত হওয়া উচিত। ভারতকে বলি, আমরা সমমর্যাদা আর সমানাধিকারভিত্তিক বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। শেখ হাসিনার সরকার বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারত-তোষণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তবে ভারতকে বুঝতে হবে, এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। এ বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাশীল। এ বাংলাদেশ নির্ভীক একটি তরুণ সম্প্রদায়ের।
যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, যদি ভারতের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো হাইকমিশনকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী থেকে সাহায্য চাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য অতিরিক্ত সৈন্য প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা বাড়াতে পারে।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক সাঈদ আহমেদ সরকার মঙ্গলবার বলেন, ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বোঝা দরকার যে, এখানে একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। বাংলাদেশকে আগের মতো ট্রিট করলে সেটা তাদের ভুল হবে। আমাদের বক্তব্য হলো, তোমরা তোমাদের জায়গায় থাক। আমাদের দেশে হিন্দু বলে কোনো কথা নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, ভারতের উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কারণে দুপক্ষের সম্পর্কে টানাহেঁচড়া চলছে। ভারত সরকারের উচিত এ উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বাংলাদেশ কখনোই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখে না, বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে থাকে। ভারতের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য প্রচার করছে। বাংলাদেশের উচিত এমন মিথ্যা তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা। এজন্য ভারতসহ বিশ্বের সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় এনে প্রকৃত চিত্র দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, দুপক্ষের মধ্যে টেনশন জিইয়ে রাখছে ভারত সরকার। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির লোকজনই আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা চালিয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় অপপ্রচার চালাচ্ছে। পুরো টেনশন রেইজের ক্যাম্পেইন করছে ভারত। এতে অনেক সীমান্ত পয়েন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। ভারত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশিরা সচেতন বলে তা সম্ভব হচ্ছে না। ভারতের যারা এগুলো করছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। ডিসেম্বরে দুপক্ষের মধ্যে এফওসি হওয়ার কথা রয়েছে। ভারত যদি পরিপক্ব হয় তবে এ বৈঠক হবে। বৈঠকের মধ্য দিয়েই দুপক্ষের টেনশন কমতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও ভারত দুপক্ষই দায়িত্বহীন কাজ করছে। দুপক্ষের জন্যই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত আরামে থাকতে পারবে না। ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশও ভালো থাকতে পারবে না। দুপক্ষকেই সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে তাদেরই কথা বলা উচিত যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভারতের মিডিয়া অপপ্রচার করছে, যা ঠিক নয়। সাংবাদিকদের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ কাম্য। আবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্রও হচ্ছে। এখানে সতর্ক থাকতে হবে। ডিসেম্বরে দুপক্ষের মধ্যে যে এফওসি হওয়ার কথা রয়েছে তা এ সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমন বৈঠক দুপক্ষের মধ্যে বেশি বেশি হওয়া উচিত।