মোঃ মামুন হোসেন: দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিতে এমন এক অসুস্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে সন্ত্রাসীরা অপরাধের ইতিহাস নিয়েও বারবার ক্ষমতার চৌকাঠে প্রবেশ করে। এই চিত্র নতুন নয়—বরং এটি একটি ধারাবাহিকতা, যা সমাজে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ক্ষমতার পালাবদলে আমরা দেখি—এক সময়ের কুখ্যাত অপরাধীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে পড়ে, কখনো পুরনো পরিচয়ে আবার কখনো নতুন মুখোশ পরে। তারা কখনো দল বদল করে, কখনো ক্ষমতাসীনদের আনুগত্য প্রকাশ করে নিজেদের রক্ষা করে এবং নতুনভাবে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে।
এই অপসংস্কৃতির শেকড় বহু গভীরে প্রোথিত। একদল অপরাধী যখন একটি দলের ছায়ায় অপকর্ম করে, তখন তারা রাজনীতি, প্রশাসন ও আইনের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করে। ক্ষমতার পালাবদলে তারা আবার দলবদল করে নতুনভাবে জায়গা করে নেয়। ফলে অপরাধের শাস্তি তো দূরের কথা, বরং তারা পুরস্কৃত হয় নেতা বা জনপ্রতিনিধি হয়ে। অথচ তাদের ইতিহাস ভয়াবহ—মানুষের রক্তে রঞ্জিত, জমি দখলের কাহিনিতে পূর্ণ, চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকি এবং সমাজকে আতঙ্কে রাখার নজির তাদের নামের সঙ্গে জড়িত।এই সংস্কৃতি শুধু অপরাধীদের পুনর্বাসন নয়, বরং সমাজের ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও নৈতিক নেতৃত্বের মৃত্যু ঘটায়। এমন একটি সমাজ তৈরি হয় যেখানে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সত্য বলা ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দমন করা হয়। এই সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যেখানে অপরাধী জানে, একটু কৌশল করলেই শাস্তির বদলে পুরস্কার পাওয়া যায়।
আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এই চিত্রকেই বারবার সামনে এনে দেয়। এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে ঘোরে, জমি দখল করে, সাধারণ মানুষকে হুমকি দেয় এবং চাঁদা তুলে রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। তারা একদিকে প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে, অন্যদিকে নিজেদের দলের “ক্যাডার” পরিচয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয়। ক্ষমতার পরিবর্তনে তারা দলবদলের মাধ্যমে আবার ‘বিশ্বস্ত কর্মী’ হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতা আমাদের সমাজে ন্যায়বিচারের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
বিশেষ করে যখন রাজনীতিতে আদর্শ হারিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতালোভী, সুবিধাবাদী ও অপরাধী চক্রের আধিপত্য তৈরি হয়, তখন রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হয়। কোনো অপরাধী রাজনৈতিক ছায়া পেলে বিচার হয় না। বরং ভুক্তভোগী হয় হয়রানির শিকার। ফলে সাধারণ জনগণের মনে জন্ম নেয় গভীর ক্ষোভ, হতাশা এবং রাজনীতির প্রতি অনাস্থা।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় পরিচয় নয়, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। কেউ দলের কর্মী হলেই সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এই বার্তা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরাধী যেই হোক, তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় ছাড়পত্র বা ক্ষমতার আশ্রয়ে কোনো অপরাধী যেন পার না পায়, সেটি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে না।দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা রক্ষা করা জরুরি। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা বিচার বিভাগ যদি রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হয়, তবে তারা কোনোদিনই প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবে না। বরং তারা নিরীহ মানুষের উপর দমন চালাবে, আর প্রকৃত অপরাধীরা থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষিত শ্রেণিকে আওয়াজ তুলতে হবে। ন্যায়বিচারের পক্ষে এবং অপরাধীদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজ যদি সন্ত্রাস ও অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়, তবে রাজনীতি কখনোই পরিশুদ্ধ হবে না। সুশীল সমাজকে আর নীরব দর্শক হয়ে থাকা যাবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তরুণ প্রজন্মকে সচেতন ও আদর্শবাদী করে গড়ে তোলা। রাজনীতি মানে যদি সুবিধা, অর্থ আর অপরাধের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রাজনীতিকে ঘৃণা করবে। অথচ রাজনীতি হওয়া উচিত জনসেবার মহৎ একটি মাধ্যম। সন্ত্রাস ও অপরাধীরা যদি রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখে, তাহলে একটি প্রজন্ম দুর্নীতিকে ‘সফলতা’ হিসেবে শেখে—যা একটি জাতির জন্য চরম আত্মঘাতী।শেষ কথা হলো, রাজনৈতিক অপরাধীদের পুনর্বাসনের সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করছে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় সংকট। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত চেতনা, সাহস এবং ন্যায়ের পক্ষে অটল অবস্থান প্রয়োজন। অন্যথায় ভয়ের সংস্কৃতি, সন্ত্রাসী আধিপত্য এবং বিচারহীনতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অন্ধকার গহ্বরে পরিণত হবে। রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত ও নৈতিক করতে হলে আজই শুরু করতে হবে পরিবর্তনের লড়াই।