তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পার হয়েছে। গভীর হয়েছে বিশৃঙ্খলা-বিভ্রান্তি। দেশটি এখন অর্থনৈতিক পতনের দ্বারপ্রান্তে। এমন পরিস্থিতিতে তালেবান আফগানিস্তানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন সরকারের ঘোষণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। তালেবানের ঊর্ধ্বতন নেতা ও কয়েকটি সূত্রের বরাতে এমন খবর জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
বেশ কিছু সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, শুক্রবার ফজরের নামাজের পরই মন্ত্রিসভার ঘোষণা আসতে পারে। তালেবান কর্মকর্তা আহমাদুল্লাহ মুত্তাকি টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় জানিয়েছেন, কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে।
টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আসন্ন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে সব বন্দোবস্ত করছে। আসন্ন অনুষ্ঠানে আফগানিস্তানের নতুন সরকারের ঘোষণা করা হবে।’ তার টুইটে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কিছু ছবিও পোস্ট করেছেন তিনি।
আফগান গণমাধ্যম তোলো নিউজ জানিয়েছে, সরকার গঠনের ঘোষণা আসন্ন। তালেবান প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে যাচ্ছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবেন তিনি। দ্বিতীয় প্রধান হবেন নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা তালেবান মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর হাতে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত অনির্বাচিত পরিষদের মাধ্যমে শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে আফগানিস্তান শাসন করলেও এবার নমনীয় হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের এমন আশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও যে কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা নির্ভর করবে ক্ষমতায় আসার পর তালেবান কি করে তা দেখার ওপর।
কান্দাহারের ধর্মীয় পণ্ডিত হাইবাতুল্লাহ— যার ছেলে আত্মঘাতী বোমারু ছিলেন— ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির মতোই ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক প্রধানের ভূমিকা পালন করবেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা, বর্তমান উপপ্রধান ও সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার আফগানিস্তানে নতুন সরকারের প্রধান তথা দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লাহ মোহাম্মদ ওমরের ছেলে মোহাম্মদ ইয়াকুবের মতো জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতারা আফগানিস্তানের নতুন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে যাচ্ছেন বলে ওই প্রতিবেদনে জানিয়েছে গার্ডিয়ান।
তালেবানের জ্যেষ্ঠ নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই বুধবার বলেছেন, নারীরা কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কিন্তু মন্ত্রিসভায় তাদের ‘স্থান’ নাও থাকতে পারে। এরপর আজ বৃহস্পতিবার নতুন সরকারে নারীদের রাখার দাবিতে অর্ধশত নারী বিরল এক বিক্ষোভ করেছেন।
বিপুল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে নতুন সরকারকে। তীব্র খরা, ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর মধ্যে জাতিসংঘ দেশটির চার কোটি মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের পড়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকের অচলাবস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র মতো বিদেশি সংস্থাগুলো তহবিল, সহায়তা ও ঋণদান বন্ধ করে দেওয়ায় নগদ অর্থের সংকটে আগে থেকেই ভঙ্গুর আফগানিস্তানের অর্থনীতি এখন ভেঙে পড়ার পথে।
শুধু সরকার গঠন করাই নয়, অর্থনীতির বিপর্যয় ঠেকাতে তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক দাতা ও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে নতুন সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েকদিন ধরে নগদ অর্থের জন্য রাজধানী কাবুলের প্রতিটি ব্যাংক ও এটিএম বুথে লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে। দিন যত গড়াচ্ছে ততই সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। আফগানদের অনেকের হাতেই নগদ অর্থ নেই, আর চাইলেও তারা অর্থ তুলতে পারছেন না।
অর্থের অভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রমে এমন বিঘ্নের মধ্যে আফগানিস্তানে চলমান প্রকল্পগুলোতে সর্বশেষ তহবিল স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আফগানিস্তানে সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল।
জার্মানি, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনসহ কয়েকটি দেশ আফগানিস্তানে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) উন্নয়ন সহায়তা তহবিল (ওডিএ) বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও জব্দ হয়েছে।
আফগানিস্তান এমনিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত। তালেবানের ক্ষমতা দখলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেই তীব্র খরার মুখে পড়েছে ৭০ লাখ কৃষক। তাদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা।