রুদ্রবার্তা২৪.নেট: রূপগঞ্জে সজীব গ্রæপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডের সেজান জুস কারখানায় গত (৮ জুলাই) বৃহস্পতিবার লাগা ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও স্বজনহারা পরিবারগুলোর আর্তনাদ থেমে নেই। নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পাবার আশায় ভীড় করছে কারখানার চারপাশে। তাদের আহাজারিতে স্তব্দ পুরো রূপগঞ্জ। ৫১ জন নিখোঁজের তালিকা থেকে সনাক্ত করা হয় এর মধ্যে রয়েছে ১৬ শিশু। সম্ভবত তারাও আগুনে পুড়ে মারা গেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি নারায়ণগঞ্জ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কার্যালয়ের তালিকায় তথ্য এবং স্বজনদের খুঁজতে থাকা পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিখোঁজ শিশুদের এ সংখ্যাটি বের করা হয়েছে। এদের বয়স ১৩ থেকে ১৬ এর মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে এখনো পোড়া লাশের গন্ধে ভারী হয়ে আছে রূপগঞ্জের বাতাস। গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে পুড়ে যাওয়া প্লাষ্টিক, প্যাকেজিং কাজে ব্যবহৃত কাগজ, কেমিক্যাল ও কারখানার বিভিন্ন উপকরণের। ২০ ঘন্টার ভয়াবহ আগুনে ৪৯ জন শ্রমিক পুড়ে আঙ্গার। দেখে চেনার কোন উপায় নেই কোনটা নারী কোনটা পুরুষ কোনটা শিশু। রয়েছে শুধু তাদের হাড়গুলো। স্বজনরা পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের হাড়গুলো নিতে একবার ছুটছেন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে আবার কারখানার সামনে। তাদের দিগি¦দিক ছুটোছুটি আর আর্তনাদ দেখে মনে হয় কারখানার আগুনে এখনো পুড়ছে এই স্বজন হারা পরিবারগুলো।
একটু সুখের আশায় ও পরিবার নিয়ে ঈদের আনন্দে মেতে উঠতে দিন-রাত এমনকি ছুটির দিনেও কর্মব্যস্ত ছিল শ্রমিকরা। কিন্তু হঠাৎ কারখানার ভয়াবহ অগ্নিকাÐ কেড়ে নিয়েছে সেই শ্রমিকদের সব ঈদ আনন্দ। এমন অগ্নিকাÐ আগে কেউ দেখেনি। যে আগুন শ্রমিকদের পুড়ে অঙ্গার করে দিয়েছে। অগ্নিকাÐে স্বজন হারা পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে শোকের ছায়া। আর চারদিকে পোড়া লাশের গন্ধ। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পুরো রূপগঞ্জ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও সেজানজুসের গেইটের সামনে এখনো ভিড় কমেনি স্বজনদের। কেউ বলছে তার মেয়ে নেই, কেউ বলছে তার স্ত্রী নেই, কেউ বলছে তার বোন নেই। এভাবেই আহাজারি আর আর্তনাদ করতে দেখা যায় অনেককে। তাদের মধ্যে অনেকেই ডিএনএ টেস্ট করার জন্য রক্ত দিয়েছেন জানা গেছে। আবার অনেকে জানতে এসেছেন স্বজনদের লাশ কবে পাওয়া যাবে।
এসময় কথা হয় বড় বোন শাহানাকে হারিয়ে দিশেহারা ১৩ বছর বয়সী শামীমার সাথে। সে জানায়, তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার জশুদা এলাকায়। তারা ৫ বোন, তাদের ভাই নেই। তাদের গ্রামের বাড়িতে কোন কাজ না থাকায় বাবা নিজাম উদ্দিন তাদের পাঁচ বোনকে নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভূলতা ইউনিয়নের পাঁচাইখা এলাকার মাফুজের বাড়িতে ভাড়া থাকেন।
অভাবের তাড়নায় এবং বাবা নিজাম উদ্দিনকে সাহায্য করতে এই সেজানজুস কারখানায় কাজ নেয় তারা দুই বোন। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছে তারা। গত বৃহস্পতিবার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাÐের ঘটনায় বড় বোনকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। বোনের লাশের খোঁজে তার বাবা নিজাম উদ্দিন রক্ত দিয়েছে বলে জানায় সে।
সে কান্না জড়িত কণ্ঠে আরো জানায়, তার বড় বোনের স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে এখনো বুঝি কারখানার জানালা দিয়ে ডাকছে শামীমা আমাকে বাঁচা। শাহানা বলে ছিলো এই কোরবানীর ঈদে বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে ঈদ করবে এবং একই রঙের জামা পড়বে” বার বার তার মনে পড়ছে বড় বোন শামিমার সেই কথাগুলো। গত ঈদে তারা বাড়ি যেতে পারেনি। কারণ ঈদের দিনও এই কারখানা খোলা ছিল। এছাড়া তাদের দু’মাসের ওভারটাইমের টাকাও বকেয়া ছিল। কারখানার মালিক তাদের জানিয়েছে এই কোরবানীর ঈদে দু’মাসের ওভারটাইমের বকেয়া টাকাসহ ঈদ বোনাস দিবে। তাই তারা দিন-রাত এমনকি ছুটির দিনেও কাজ করতো। যাতে একটু বেশি টাকা পায়।
এসময় কথা হয় আরও একটি পরিবারের স্বজনদের সাথে। এমন এক অসহায় স্বামী রাজীব আজ সেজান জুস কারখানার গেইটে দাড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে কান্না করছে আর বলছে তার মা আর কখনো আসবে না। তিনি স্ত্রীকে হারিয়ে আজ দিশেহারা। ছেলের সুখের জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এক সঙ্গে সেজান জুস কারখানায় কাজ করতেন। এদিকে তার পাঁচ বছরের ছেলে রাফিনের বায়না ‘সে মায়ের সাথে সকালে নাস্তা করবে। তাই ছেলেকে নিয়ে এই কারখানার সামনে এসেছেন সান্তনা দিতে যে, ‘মা কারখানার ভিতরেই আছেন’।
রাজীব জানান, তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। সে দীর্ঘদিন যাবৎ স্ত্রী ও পাঁচ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ৫নং ক্যানেল এলাকায় ভাড়া থাকেন। তিনি সেজানজুস কারখানায় হটফিলিং এ কাজ করেন। তার স্ত্রী আমেনা (২২) একই কারখানার আইচপপে কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার কারখানায় আগুনের ঘটনায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে তার স্ত্রী আমেনা মারা যান।
বর্তমানে তার লাশ ঢাকা কলেজ মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। কিন্তু এই পাঁচবছরের শিশুকে তিনি কি জবাব দিবেন? ‘সে তার মার সাথে সকালে নাস্তা করবে বলে বায়না ধরছে’ তা বুঝতে না পেরে। এই কারখানার সামনে নিয়ে এসেছেন বলে জানান তিনি। রাজীব কথাগুলো বলছেন আর তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। ছেলেটি তার বাবার মুখে তাকিয়ে রয়েছে। আর মায়ের বের হওয়ার অপেক্ষা করছে।
রাজীব আরো জানান, এই কোরবানী ঈদকে ঘিরে তার স্ত্রী আমেনার অনেক স্বপ্ন ছিলো। কারখানায় পাঁচ মাসের ওভার টাইমের টাকা বকেয়া থাকায় গত রোজার ঈদেও সে বাবার বাড়ি যাইনি। তবে সে ভেবেছিল এই ঈদেই যদি ওভার টাইমের বকেয়া টাকা পায় তাহলে সবার জন্য কিছু কিনে নিয়ে বাড়িতে যাবে। কিন্তু কারখানার মালিক পাঁচ মাসের মধ্যে দু’মাসের বকেয়া পরিশোধ করেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে ঈদের আগের বকেয়া ওভারটাইমের টাকাসহ ঈদ বোনাস দিবে। তাই দিন-রাত এই ছোট শিশুকে ভাড়া বাসায় রেখে কাজ করতো আমেনা। এমনকি ছুটির দিনেও কাজ করতে হতো তাদের ।
জানা গেছে, গত বহস্পতিবারে শ্রমিকরা বিধ্বংসী আগুন থেকে বাঁচতে যে জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটি ভবনের দ্বিতীয় সিড়ি থেকে মাত্র দুই গজ দূরে অবস্থিত। তবে একটি লোহার গ্রিল দিয়ে সিঁড়িটিকে কারখানার অংশ থেকে আলাদা করে রাখা ছিল।
দমকল বাহিনীর একজন কর্মী জানান, সিঁড়িতে পৌঁছানোর গেটটি তালাবদ্ধ না থাকলে যারা ফ্লোরে পুড়ে মারা গেছেন, তারা জীবন বাঁচাতে পারতেন। তারা ভবনের ছাদে পৌঁছে যেতে পারতেন। নকশা অনুযায়ী ওই ভবনটিকে গুদাম হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করত বলেও জানান তিনি।
কারখানার তৃতীয় তলার শ্রমিক পারভেজ তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার সময় আমরা কাজ করছিলাম। প্রথম তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর সবাই চিৎকার করতে শুরু করে। পুরো ব্যাপারটা তখন দোজখের মতো মনে হচ্ছিল। আমরা যখন প্রথম সিড়িটি দিয়ে ভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম, তখন দেখলাম সেখানে আগুন লেগে গেছে। আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ভাগ্যবান মানুষ দ্বিতীয় সিড়ি দিয়ে বের হতে পেরেছিলাম। বাকিরা ভেতরে আটকা পড়ে, পরে অনেকে ভবনের ওপর থেকে লাফ দেয়। চতুর্থ তলায় দ্বিতীয় নির্গমন পথটি তালাবদ্ধ ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আগুন চারপাশের সব কিছু ধ্বংস করে ফেলে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দেবাশীষ বর্ধন জানান, ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ রয়েছে। যদি আবারও আগুন লাগে, আমরা এখানে এসে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। এ ভবনটি ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি বলেও জানান তিনি। আমরা কারখানাভবনগুলোর জন্য অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা দেই। তবে, এই ভবনটির জন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
প্রসঙ্গত, হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানায় অগ্নিকাÐে ৫২ জনের মৃত্যুও ঘটনায় ৬ তলা ভবনটি ৩ বছর আগেও ছিল কেন্দ্রীয় গুদাম ঘর। এছাড়াও ফায়ার সেফটি প্ল্যান না নিয়েই কারখানা হিসেবে গড়ে তােলা হয়। এখন ভবনটি আগুনে পুড়ে কঙ্কালে রূপ নিয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার সজীব গ্রæপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেডের সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার ২০ ঘণ্টা পর কারখানার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আরো ৪৯ জন হতভাগ্য শ্রমিকের মরদেহ। কারখানাটির ৪র্থ তলা থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে এই ওই মরদেহগুলো। এর আগে অগ্নিকান্ডের পর লাফিয়ে বের হতে গিয়ে ৩ জনের মৃত্যু ঘটে। অগ্নিকাÐে ৫২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ নাজিমউদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টা ও হত্যার উদ্দেশ্যে সামান্য ও গুরুতর জখমের অভিযোগ করা হয়। ওই মামলায় ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১০ জুলাই শনিবার বিকেলে তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুনের আদালত ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে হাজির করা হলে আদালত ৪ দিনের রিমাÐ মঞ্জুর করেন। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- আবুল হাসেম (৭০), হাসীব বিন হাসেম (৩৯), তারেক ইব্রাহীম (৩৫), তাওসীব ইব্রাহীম (৩৩), তানজীম ইব্রাহীম (২১), শাহান শান আজাদ (৪৩), মামুনুর রশিদ (৫৩), মো. সালাউদ্দিন (৩০)।