ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরে কয়েক মাসের মধ্যে অন্যতম বড় শেষে জেনিন শহর ছেড়েছে ইসরাইলি সেনারা। ৯ দিনের অভিযানে ওই এলাকার হাজার হাজার অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
অভিযানে সেনারা হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং ফাতাহর মতো ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। এদিকে গাজায় ১১ মাস ধরে চলা যুদ্ধে প্রতিদিনই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে সেখানকার শিশুরা। তাদের গান শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ার ও যুদ্ধের বিভীষিকা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউসেফ সাদ নামের একজন খুদে শিল্পী। খবর আলজাজিরা ও রয়টার্সের।
জেনিন ছেড়েছে আইডিএফ : ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) প্রসঙ্গে জেনিনের অধিবাসী সামহার আবু নাসা বলেন, ‘তারা যখন শহরে ঢুকেছিল, তারা বুলডোজার ব্যবহার করেছে এবং সবকিছু ধ্বংস করতে শুরু করেছিল। কোনোকিছুই তারা বাদ রাখেনি।’
পানি ও বিদ্যুৎসেবা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ কিলোমিটার রাস্তা। তবে আইডিএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাস্তার নিচে পাতা ৩০টি বিস্ফোরক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলি সেনারা সরে যাওয়ার পর এখন রাস্তা পরিষ্কারের কাজ চলছে।
শত শত ইসরাইলি সেনা ও পুলিশ হেলিকপ্টার ও ড্রোনের সহায়তায় জেনিনের শরণার্থী শিবির ও আশপাশের গ্রামসহ সব জায়গায় অভিযান চালিয়ে পুরো এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী আলজাজিরাকে বলেছেন, শহরের অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতি করে গেছে ইসরাইলি বাহিনী। তাদের অভিযানে ২১ জন নিহত হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এক খুদে বাদ্যশিল্পী : গাজার ১৫ বছর বয়সি কিশোর ইউসেফ সাদ। ইসরাইলের বিমান হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের ক্রমাগত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন সাইকেলে চেপে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে খুদে এই বাদক। এ সময় পিঠে ঝোলানো থাকে ওদ নামে তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটি। যুদ্ধের বিভীষিকা ও ভয়াবহতা ভোলাতে শিশুদের গান শোনানো তার উদ্দেশ্য।
‘আমার শহরের বাড়িগুলো একসময় স্বপ্নে ভরপুর ছিল। এখন সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে’, কয়েক দশকের পুরোনো জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের ধ্বংসস্তূপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল কিশোর সাদ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শিবিরটি স্থাপন করা হয়, যা ছিল খুবই ঘনবসতিপূর্ণ।
গাজা সিটির কাছে অবস্থিত এডওয়ার্ড সাইদ ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব মিউজিকের শিক্ষার্থী সাদ। ইসরাইলের হামলায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো গাজা উপত্যকাই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সেনাদের তাণ্ডবে ইউসেফ সাদের বাড়িও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ফলে এখন অন্য স্বজনদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে তাকে। সাদের ভাইবোন পাঁচজন। তাদের সবার জীবনই ওলট-পালট।
খুদে বাদক সাদের বাবা ফিলিস্তিনের সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সন্তানের বাদ্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন। তবে এখন সাদের মনোযোগ অন্যদিকে। জাবালিয়া দিবাকেন্দ্রে গাজার যুদ্ধে আতঙ্কগ্রস্ত শিশুদের জন্য গান গেয়ে ও ওদ বাজিয়েই দিন কাটে তার। বিপদ সত্ত্বেও সাদ তার কাজ চলিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অটল। সে রয়টার্সকে বলেছে, আমরা তাদের (শিশুদের) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এমনকি এ জন্য আমার নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতেও হতে পারে। শিশুদের প্রতি এটি আমার কর্তব্য।
সাদ বলে, ‘গাজার প্রতিটি ঘরেই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা আছে। কেউ মা হারিয়েছে, কেউ বাবা, কেউ প্রতিবেশী অথবা কেউ বন্ধু।’ ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখাও ছাড়তে নারাজ সাদ। তার কথায়, ‘আমরা ফিলিস্তিনি শিশুরা গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়েও শক্ত ও প্রাণবন্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’ সাদ আরও বলেছে, একটি কথা তাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। তা হলো, ‘বাঁচলে মুক্তভাবে বাঁচো, নয়তো গাছের মতো দাঁড়িয়ে মরো।’