বন্দরের নাজিমউদ্দিন ফকিরচান স্কুলের এক এসএসসি শিক্ষার্থী আবির হাসান (ছদ্দ নাম)। আসন্ন পরীক্ষার পূর্বে তার ইউনিক আইডির জন্য প্রয়োজন জন্ম সনদ। জন্ম সনদের তাগিদে মাকে নিয়ে দুইমাস যাবৎ আসা যাওয়া করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ভবনে। সপ্তাহ খানেক পরপর নিজের জন্ম সনদ খোঁজে এলেও নাসিকের কদমরসূল অঞ্চলের অফিস থেকে ফিরছেন খালি হাতে। জন্মসনদের অভাবে থমকে আছে তার ইউনিক আইডির তথ্য ছক পূরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম। শুধু আবির নয় তার মতো একই ভোগান্তিতে রয়েছেন সিটি করপোরেশনের শত শত শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের নাগরিক।
টিকা নিবন্ধন কিংবা ইউনিক আইডি, দুটো ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন জন্মনিবন্ধন। আবিরের মতো একাধিক শিক্ষার্থী জন্মসনদের জন্য সিটি করপোরেশনে অপেক্ষায়মান। নিজের ভোগান্তির বিষয়ে আবির বলেন, আমি লকডাউনের সময় জন্মনিবন্ধনের জন্য আসি। তখন আমাকে একটা ফরম পূরণ পরবর্তী জমা দিয়ে সপ্তাহ খানেক পড়ে আসার জন্য বলে এখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা। আমি প্রায় এক মাস জন্মসনদের জন্য ঘোরার পর আমাকে জানানো হয়, অনলাইনে আবেদন করতে হবে। আমাকে শুরুতে এই বিষয়ে জানানো হয়নি। অনলাইন আবেদন পরবর্তী একমাস হয়ে গেছে আমি এখনো জন্মসনদ পাইনি। জন্মসনদ নিতে আসলে আমাকে কিছু জন্মসনদের ফাইল দেখিয়ে সেখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী বলেন, এগুলোর মধ্যে চেক করো। যদি হয় তাহলে এখানে থাকবে। আমি প্রায়ই এসে চেক করি কিন্তু আমার নামের জন্ম সনদ পাইনি।
এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যাবেন ফরিদা বেগম (ছদ্ম নাম)। পাসপোর্টের প্রয়োজন ইংরেজি ভাষান্তরিত জন্মসনদের। কিন্তু জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত ফরম জমা দেওয়ার তিন মাস পেরুলেও পাননি জন্মসনদ।
ফরিদা বেগম বলেন, আমার স্বামী ও আমার বাচ্চাদের জন্মসনদের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছি মাস দুয়েক আগে। বন্দর অফিসে ফি সহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিয়েছি । আবেদন পরবর্তী জন্ম সনদের জন্য গেলে সব সময় কর্মচারীরা বলে, জন্মসনদ ফাইলে চেক করেন। কয়েকদিন ফাইলে চেক করেও পাইনি। দেড় মাস পড়ে একদিন বলে আমার অনলাইন আবেদন তারা পাননি। পুনরায় অনলাইন আবেদন করে ফি সহ সকল কাগজপত্র পুনরায় জমা দিতে বলেন। বাধ্য হয়ে আবারো সব জমা দিয়েছি। এর দুই সপ্তাহ পরে গেলে বন্দরের এই বিভাগের কর্মচারী মমতাজ বেগম বলেন, আপনার স্বামীর আবেদন হয়েছে। আর বাচ্চাদেরটা ডিসি অফিস থেকে বাতিল করে দিছে। পুনরায় আবেদন করতে হবে। ফি সহ এক সপ্তাহ আগে দুই সন্তানেরটা আবার আবেদন করেছি। কিন্তু কেন বাতিল হয়েছে সেই বিষয়েও আমাকে কিছু বলেনি।
আজকে ( রোববার ২৬ সেপ্টেম্বর) আসছি। একই কথা বলা হয় আমাকে। আমার স্বামীর জন্মসনদ বলেছে হয়েছে। কিন্তু সেটাও ফাইলে খুঁজতে দেয়নি। আর কত ভোগান্তির শিকার হবো আমরা?
এদিকে কদমরসূল অঞ্চলের একাধিক ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, জন্মসনদ গুলো ওয়ার্ড ভিত্তিক ফাইল করা হয় না। জন্ম সনদ ফাইলের পাশাপাশি ঝুড়িতে ফেলে রাখা হয় জন্মসনদ। একাধিক ওয়ার্ডের জন্ম সনদ একসাথে রাখা হয়। ওয়ার্ডভিত্তিক থাকলে ভোগান্তি কিছুটা হ্রাস পাবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীগণ। তাদের অভিযোগ এই কার্যালয়ের মমতাজ নামে একজন নারী কর্মকর্তা আছেন। তার ব্যবহার খুব বিশ্রি। কয়েকবার জিজ্ঞেস করলে একবার তিনি উত্তর দেন। বাজে ব্যবহার করেন নাগরিকদের সাথে।
ওদিকে প্রায় একই ভোগান্তি ও সমস্যায় রয়েছে সিটি করপোরেশনের অন্য দুটি অঞ্চল। নগরভবনের প্রধান অফিসে জন্মসনদ গ্রহণ করতে এসেছেন ১৭ ওয়ার্ডের বাসিন্ধা অনিমা (ছদ্ম নাম)। তিনি চার-পাঁচদিন যাবৎ ঘুরছেন ফরম পূরণ সহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য। জন্ম নিবন্ধন করতে প্রয়োজন ডাক্তারের প্রত্যয়নপত্র। এই প্রত্যয়ন পত্র সংগ্রহের জন্য তার ওয়ার্ডের নির্ধারিত ডাক্তার শরণাপন্ন হলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার জানান, ভুক্তভোগী বরিশালের স্থায়ী বাসিন্ধা হওয়ায় তাকে প্রত্যয়নপত্র দিতে পারবেন না। অনিমা বলেন, আমি সিটি করপোরেশনে থাকি অনেক বছর যাবৎ। এখানের ভোটার। কিন্তু এখানের ডাক্তার আমাকে বরিশাল থেকে প্রত্যয়ন সনদ আনতে বলে। বরিশালের ডাক্তার বলছে, ‘আপনি থাকেন নারায়ণগঞ্জ, ওইখানের ভোটার। আমি কিভাবে সার্টিফিকেট দিবো।’ কেউ যদি সাটিফিকেট না দেয় আমি এখন কি করব?
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নাম প্রকাশে একজন কর্মী বলেন, আমরা সাধারণত আবেদনের একমাস পরে জন্মসনদ দেই। কিছু ক্ষেত্রে দেরি হয়, কারণ নতুন নিয়মে অনেক তথ্যের প্রমাণপত্রের প্রয়োজন হয়। জন্মসনদের ২০০১ সাল ও তার পরবর্তী সালের শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা-মা দুজনের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এছাড়া সংশোধন কিংবা ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে সাধারনভাবে সংশোধন করা যায় না। কয়েকটি দপ্তরে একাধিক ধাপ পার করে সংশোধন করতে হয়। বাবা ও মায়ের জন্মসনদ যদি বাংলায় হয় তাহলে সন্তান বাংলায় একটা জন্ম নিবন্ধন পাবে। আর দুটোই ইংরেজিতে হলে জন্ম নিবন্ধন পাবে ইংরেজিতে। কিন্তু যদি দুজনেরটা আলাদা হয় তাহলে দুজনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এ জন্য আবেদনকারীদের কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সহকারী সচিব ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানার সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতিদিন অনেক আবেদন জমা পড়ে। এজন্য দেরি হয়। এরবেশি আমি কিছু বলতে পারব না। বন্দরের বিষয় সেখানের কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী আবুল আমিন বলেন, সাধারনত ১৫ দিনের মধ্যে জন্মসনদ দিয়ে দেওয়ার কথা। কেন অতিরিক্ত সময় লাগছে। এ বিষয়ে কোন গাফলতি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।