মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরও ২৬ হাজার ২২৯টি পরিবার পাচ্ছে নতুন ঘর। বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাঁচটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে যুক্ত হয়ে এই ঘরগুলো হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্পগুলো হলো- লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্প, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্প, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চর ভেলামারী আশ্রয়ণ প্রকল্প, পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাহানপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার জঙ্গালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প।
বৃহস্পতিবার পঞ্চগড়ে ১৪১৩টি ও মাগুরায় ৯৬টি বাড়ি হস্তান্তর হবে। পঞ্চগড় জেলায় ৫টি ও মাগুরায় ৪টি উপজেলা রয়েছে। বাড়িগুলো হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাসহ দেশের ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
উপজেলাগুলো হলো- ঢাকার নবাবগঞ্জ, মাদারীপুরের মাদারীপুর সদর, শরীয়তপুরের ডামুড্যা, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, টাঙ্গাইলের গোপালপুর, মানিকগঞ্জের ঘিওর, সাটুরিয়া, রাজবাড়ীর কালুখালী। ফরিদপুরের নগরকান্দা, নেত্রকোনার মদন, ময়মনসিংহের ভালুকা, নান্দাইল, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, জামালপুর বক্সীগঞ্জ। চট্টগ্রামের পটিয়া, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ, ফেনীর ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পঞ্চগড় সদর, দেবীগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, বোদা। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওর বালিয়াডাঙ্গী। নীলফামারীর ডিমলা, নওগাঁর রানীনগর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, রাজশাহীর মোহনপুর, চারঘাট, বাঘা, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া নাটোরের বাগাতিপাড়া। পাবনা ঈশ্বরদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ, ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডুু, সাতক্ষীরার তালা, মাগুরার মাগুরা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর, শালিখা, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া, পটুয়াখালীর দশমিনা।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, বাড়ি হস্তান্তর উপলক্ষ্যে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কাজ চলছে। বৃষ্টির মধ্যেও প্রকল্প এলাকাজুড়ে সাজসাজ রব। বাড়িগুলোকে সাজানো হয়েছে। পাশেই সমাবেশস্থলে শামিয়ানা টানিয়ে ভেতরে সাজসজ্জার কাজ চলছে। এই ইউনিয়নেই ১৯৭২ সালে চর পোড়াগাছা গুচ্ছগ্রামে ৫৯০ একর জমি বরাদ্দের মধ্য দিয়ে প্রথম আশ্রয়ণ শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই গুচ্ছগ্রামের পাশেই চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্প। এখানেই বাড়ি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পটিতে ১৪২টি বাড়ি পাচ্ছেন ভূমিহীন ও গৃহহীনরা।
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোছাইন আকন্দ জানান, জেলায় তিন হাজার ২২৮টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার ৬৬টি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার আরও ৪৩৬টি পরিবার বাড়ি পাবে। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ ও রায়পুর উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, এ এলাকায় জেলে, বেদে, ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষরা অত্যন্ত খুশি। তাদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নতুন বাড়ি পেয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।
বুধবার চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব-১ এমএম ইমরুল কায়েস রানা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তার কন্যা সে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। একটি গৃহকে কীভাবে পারিবারিক কল্যাণে সামগ্রিকভাবে ভালো করা যায় তার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনে শেখ হাসিনা মডেল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন।
নদীতে সবহারা জীবন পেয়েছে স্থায়ী ঠিকানা : লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে বেশিরভাগই ঘর পেয়েছেন নদীভাঙা নিঃস্ব মানুষ। নদীতে এক বা একাধিকবার সবকিছু হারিয়ে এখন আপন স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছেন তারা। সেখানে শুরু করেছেন নতুন জীবন সংগ্রাম। স্বপ্ন দেখছেন নিশ্চিত জীবনের। চরবাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন কাজল রেখা। বিয়ের পর স্বামী এবং এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে সুখের সংসার ছিল। তার স্বামী জেলে। কিন্তু নদীভাঙনে সেই সুখের নীড় ভেঙে যায়। নিঃস্ব হয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। সেখানে নানা সমস্যায় দিন কাটছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহারের জমিসহ ঘর পান কাজল রেখা।
প্রায় বছরখানেক হলো আবার উঠেছেন আপন ঠিকানায়। তার স্বামী এখনো নদীতে মাছ ধরেন। কাজল রেখা নিজে সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন। বাড়ির বারান্দায় বসে কাজ করে নিজেও মাসে হাজার টাকা আয় করেন। এখন স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করা। কাজল রেখা বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের অনিশ্চয়তার জীবনে একটা গতি করে দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি- তিনি সারাজীবন আমাদের প্রধানমন্ত্রী হয়েই বেঁচে থাকুন। আমাদের পাশে থাকুন।
মো. নূর আলম ২৮ বছরের যুবক। তার জীবনের গল্পও অনেকটা কাজল রেখার মতো। বাবার বাড়ি ও কিছু জমি ছিল। নিজে করতেন রাজমিস্ত্রির কাজ। কিন্তু কয়েক বছর আগেও তাদের বাড়ি ও জমি সব নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন শ্বশুরবাড়িতে। খুব কষ্ট করে সেখানে থাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর পেয়েছেন নূর আলমও।
নারায়ণচন্দ্র শীলের বাড়ি ছিল ভোলায়। ১৯৬৯ সালে এই জেলায় আসেন তিনি। আশ্রয় নিয়েছিলেন বেড়িবাঁধে। সেখানে কোনোরকমে একটা ঘর তুলে স্ত্রী মায়া রানী ও সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। করতেন চুল কাটার কাজ। কয়েক বছর আগে সেই বেড়িবাঁধও ভেঙে যায়। আরও অসহায় হয়ে পড়েন নারায়ণ শীল। আশ্রয় নেন অন্য একজনের বাড়ির আঙিনায়। ছাপরা ঘর তুলে সেখানে থাকতেন। এখন তার পাকা বাড়ি হয়েছে। তার বাড়ির সামনে যেতেই কানে এলো তার স্ত্রী পুজো দিতে ব্যস্ত।তারা বলেন, প্রায় সারাজীবন কষ্টেই গেছে। নিজের বলতে কোনো ঠিকানা ছিল না। এই বয়সে এসে প্রধানমন্ত্রী নিজের ঠিকানা দিয়েছেন। আমরা খুব ভালো আছি।
প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি জমির মালিকানাসহ ৬৩ হাজার ৯৯৯টি ঘর হস্তান্তর করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন জমির মালিকানাসহ ৫৩ হাজার ৩৩০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত মোট একক ঘর সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি। চলমান তৃতীয় পর্যায়ে মোট বরাদ্দকৃত একক ঘরের সংখ্যা ৬৭ হাজার ৮০০টি, যার মধ্যে গত ২৬ এপ্রিল হস্তান্তরিত হয় ৩২ হাজার ৯০৪টি। বৃহস্পতিবার হস্তান্তর হবে ২৬ হাজার ২২৯টি। এ ছাড়া আরও নির্মাণাধীন রয়েছে ৮ হাজার ৬৬৭টি ঘর।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, পঞ্চগড় ও মাগুরায় আর কোনো ভূমিহীন-গৃহহীন নেই। এটি আমাদের জন্য একটি বিশাল অর্জন। গত মাসে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে আমাদের মনোবল আকাশচুম্বী হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে মানবতার ছোঁয়া পৌঁছে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শতভাগ বাস্তবায়ন করা গেছে বাংলাদেশের দুটি প্রত্যন্ত জেলা। তাই উন্নয়নের ছোঁয়া এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে।