রুদ্রবার্তা২৪.নেট: একবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ও দুই দফায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে টানা ১৮ বছর নগরবাসীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। প্রত্যেক নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন তিনি। প্রতিবারই তিনি প্রমাণ করেছেন, জনগণ তার সঙ্গে আছে।
বারবার বিপুল ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেও সহজ ছিল না ১৮ বছর তার এই পথচলা। কাঁটা বিছানো পথ ধরেই নগরবাসীর সেবা দিয়ে গেছেন তিনি। নির্বাচন সামনে এলে সেই প্রতিবন্ধকতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। অনেকটাই ঝড়ের মধ্যে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মত পরিবেশ তৈরি হয়। এই পরিবেশ তৈরি করেন তার নিজ দলের একটি প্রভাবশালী অংশ। কখনও কখনও নগর উন্নয়নের কাজেও বড় ধরনের বিঘœ সৃষ্টি করেন তারা। নির্বাচন এলেই মেয়রকে ঘায়েল করতে তার বিরুদ্ধে কল্পিত ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ খতিয়ান হাজির করেন এই অংশের লোকজন। মেয়রের বিরুদ্ধে বিষোদগারে মেতে উঠেন তারা। তাদের সেই বক্তব্যে অনেকটাই নীরব থাকেন আইভী। কারণ তার ভরসা নারায়ণগঞ্জের জনগণ। নির্বাচনে বারবার বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে ব্যালটেই সেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মোক্ষম জবাব দেন নগরবাসী। এমনটাই মত আইভী ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে নৌকার মনোনয়ন প্রার্থনা করেছেন আইভী। এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে আইভীর বিরুদ্ধে বিষোদগার। আইভী ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাবি পুরানো খেলায় মেতেছেন সেই প্রভাবশালী অংশ। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে টার্গেট করে স¤প্রীতির শহরে এখন চলছে সা¤প্রদায়িক বিষের চাষ। তার পারিবারিক বাড়ি দচুনকা কুটিরদ নিয়েও চলছে অপপ্রচার। এছাড়াও নানান অভিযোগে ক্লিন ইমেজের আইভীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে বলে দাবি তাদের।
প্রথমবার ২০০৩ সালে বিএনপির শাসন আমলে বিরাট ব্যবধানে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী নুরুল ইসলাম সরদারের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নিউজিল্যান্ড থেকে সদ্য দেশে ফিরে আসা আইভীর কাছে বিপুল ভোটে ধরাশায়ী হন বিএনপির প্রার্থী। প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে পৌরসভার ১২৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে জয়ের ইতিহাস গড়েন আইভী।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনের আইভীর সাথে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান। নানা নাটকীয়তার পর প্রায় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে হারান চুনকা কন্যা সেলিনা হায়াৎ আইভী। সেই নির্বাচনে ১৬৩টি ভোটকেন্দ্রে আইভী পেয়েছেন ১ লক্ষ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট। তার প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট।
এরপর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার প্রার্থী হয়ে আবারও মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। এই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন ৭ খুন মামলার আইনজীবী হিসেবে সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া বিএনপি নেতা অ্যাড. সাখাওয়াত হোসেন খান। তবে আইভীর জনপ্রিয়তার কাছে টিকতে পারেননি তিনি। ১৭৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ ভোট। অপরপক্ষে নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী বিএনপি সমর্থিত অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৭০০ ভোট।
৭৭ হাজার ৯০২ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র আইভী বিজয়ী হয়েছেন।
কিন্তু বারবার বিপুল ভোটে আইভীর বিজয়ের রহস্য কি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত ২০০৩ সালে আইভী যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। রাস্তায় ঠিক মতো বাতি জ্বলতো না। একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যেত। সেই পানি দীর্ঘসময়েও নামতো না। শহরের অনেক গলিতেই একটা রিকশা প্রবেশ করলে আরেকটা বের হতে পারতো না। আইভী দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৮ বছরে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন মিলে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যাপক কাজ করেছেন তিনি। আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরী গড়তে নির্মাণ করেছেন শেখ রাসেল পার্কের মতো নারী-শিশু ও পরিবেশবান্ধব বাবুরাইল ও সিদ্ধিরগঞ্জ খাল প্রকল্প। আজকে এই শহরের প্রত্যেক গলিতে গলিতে সড়ক এবং প্রধান প্রধান সড়ক প্রয়োজনের থেকেও বেশি প্রশস্ত। বাবুরাইল, সিদ্ধিরগঞ্জ ও গঞ্জে আলী খালের মতো দখলদারদের কাছ থেকে আরও অনেক খাল, পুকুর সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার, জমি উদ্ধার করে মাঠ-পার্ক, মসজিদ-মন্দির করেছেন। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ, শহরকে আলোকিত করার জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি বাতি স্থাপন করেছেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। বন্দর ও শহরবাসীর কষ্ট লাঘবে কদমরসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন ও দেশীয় সংস্কৃতি বিকাশে পাঠাগার নির্মাণ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবায় নগর মাতৃসদন ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। নারায়ণগঞ্জে মেয়র আইভীর ব্যাপক উন্নয়ন দৃশ্যমান। যা তাকে গণমানুষের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেবল নারায়ণগঞ্জেই নয় সারাদেশেই ক্লিন ইমেজের মেয়র আইভী অনন্য এক অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
মেয়র আইভী ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের দাবি, মেয়র হিসেবে যথাসম্ভব উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন আইভী। পাশাপাশি সরব প্রতিবাদ করেছেন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভুমিদুস্যতার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে ছাড় দেননি কাউকেই। নিজ দলের প্রভাবশালী অংশের প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও তিনি মাথা নত করেননি; বরং তাদের বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই ছিলেন প্রতিবাদী। এর মধ্যে দিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর বিশ্বাস ও সম্মান অর্জন করেছেন তিনি। জনগণ এ প্রতিবাদী আইভীকেই তাই আবারও মেয়র হিসেবে চান। এবারও ব্যালটের মাধ্যমে সেই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নগরবাসী জবাব দিবেন এমনটাই মত আইভী ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের।