বিদ্রোহীদের হাতে দামেস্ক পতনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে রাশিয়ায় পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস ও রিয়া নভস্তির বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মস্কোয় পৌঁছেছেন। মানবিক দিক বিবেচনা করে রাশিয়া তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের অভিযানে রোববার বাশার সরকারের পতন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে তার দুই যুগের শাসনের অবসান ঘটে।
এর আগে বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ পালাতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে গুঞ্জন উঠে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আসাদের বিমান দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছু সময় পর হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে। পরে বিমানটিকে আর রাডারে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বাশার আল-আসাদের বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে।
ওপেন-সোর্স ফ্লাইট ট্র্যাকার থেকে জানা গেছে, দামেস্ক ছেড়ে যাওয়া শেষ বিমানটি ছিল একটি ইলিউশিন-৭৬ প্লেন, যার ফ্লাইট নম্বর ছিল সিরিয়ান এয়ার ৯২১৮। ধারণা করা হচ্ছে, এই উড়োজাহাজটি আসাদকে বহন করছিল। এটি বিদ্রোহীরা বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঠিক আগে উড্ডয়ন করে। এটি প্রথমে পূর্বদিকে উড়ে যায় এবং পরে উত্তর দিকে মোড় নেয়, কিন্তু হোমসের ওপর দিয়ে চক্কর কাটার সময় এর সিগন্যাল হঠাৎ হারিয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ভিডিও শেয়ার করা হচ্ছে, যেখানে একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে।
মেডিসিন ও লন্ডন: রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বাশার আল-আসাদ ডাক্তার হিসেবেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিনি ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে যান লন্ডনের ওয়েস্টার্ন আই হসপিটালে চোখের ডাক্তার হিসেবে পড়ালেখার জন্য। সে সময় তিনি ইংরেজ গায়ক ফিল কলিন্সের অনুরক্ত হন ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হন। লন্ডনেই আসমা আল-আখরাসের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীতে তারা বিয়ে করেন। আসমা কিংস কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তেন। তিনি হার্ভার্ডে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু বাশার আল-আসাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওই মৃত্যুই মূলত বাশার আল- আসাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরি করতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
সংস্কার ও পরিবর্তনের স্বপ্ন: হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দ্রুতই প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশার আল-আসাদ। তবে এ জন্য দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বনিম্ন বয়স ৪০ বছর থাকার যে বিধান ছিল তা পরিবর্তন করতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার কথা বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাস পর তিনি আসমা আল-আখরাসকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান-হাফিজ, জেইন এবং কারিম।
প্রথমদিকে তার রাজনৈতিক সংস্কার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছিল। তার নেতৃত্বের স্টাইল ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আসমার সঙ্গে জুটিবদ্ধ হওয়া-অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। বাশার আল-আসাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত সংস্কার করলে ব্যক্তি খাত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তবে তার শাসনের প্রথম দিকে উত্থান হয় তার চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
ইরাক এবং লেবানন: ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধকে ঘিরে বাশার আল-আসাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। সম্ভবত তার আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ইরাকে তাদের বিরোধীদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানে সহায়তার জন্য দামেস্ককে দায়ী করছিল। সে সময় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর ২০০৫ সালে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি বৈরুতে বিস্ফোরণে নিহত হলে এ ঘটনার জন্য অনেকে সিরিয়া ও তার সহযোগীদের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
লেবাননের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয় ও দামেস্কের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে লেবাননে থাকা সিরিয়ার ৩০ বছরের সামরিক উপস্থিতি
প্রত্যাহার করতে হয়। আসাদ ও তার লেবাননের সহযোগী হিজবুল্লাহ অবশ্য ওই হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। যদিও পরে বিচারে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হিজবুল্লাহর কয়েকজন সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়।
আরব বসন্ত: বাশার আল-আসাদের শাসনের প্রথম দশকে ইরান, কাতার এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও শুরুতে রিয়াদ তরুণ প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। মূলত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাশার তার পিতাকে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু শাসন শুরুর এক দশক পর কর্তৃত্ববাদের দিকে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। শুরু হয় বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন। ২০১০ সালে আসাদের স্ত্রী ভোগ ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তাতে তার ঘরে গণতন্ত্র আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
ওই একই সময়ে তিউনিসিয়ায় একজন সবজি বিক্রেতা পুলিশের চড় খেয়ে ক্ষোভে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, সেটিই আরব বসন্তে রূপ নেয় ও এক পর্যায়ে বিদায় নিতে বাধ্য হন তিউনিসিয়ার তখনকার প্রেসিডেন্ট বেন আলি। এটিই তখন পুরো আরব অঞ্চলে, বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন এবং সিরিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে উৎসাহী করে তোলে। এক পর্যায়ে ২০১১ সালের মার্চে দামেস্কে বিক্ষোভ দেখা যায় এবং পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দারারাতে দেয়ালে আসাদবিরোধী স্লোগান লেখার দায়ে শিশুদের আটক করা হলে সেখানেও আন্দোলন শুরু হয়।
দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করে আসাদ পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সিরিয়াকে টার্গেট করে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে একে মোকাবিলার কথা বলেছিলেন। তবে অনেক মানুষের যে মৌলিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে না তাও স্বীকার করেন তিনি। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী দারারাতে শক্তি প্রয়োগ করলে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। অনেক শহরে আসাদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। কর্তৃপক্ষ সহিংস পন্থায় তা দমনের চেষ্টা করে। কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে, কারণ সরকারি বাহিনী ও সশস্ত্র বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে দেশজুড়ে সংঘর্ষ হতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ, জিহাদ ও যুদ্ধাপরাধ: সংঘাত বেড়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘের হিসাবে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রাশিয়া, ইরান এবং ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আসাদের বাহিনীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে তুরস্কসহ কিছু উপসাগরীয় দেশ সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেয়।
শুরুতে আসাদবিরোধীরা গণতন্ত্র ও মুক্তির কথা বললেও দ্রুতই সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টিও উঠে আসে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের বদলে আসাদ নিজের অ্যালাউইটস গোত্রের লোকজনকে সুবিধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সূত্র ধরে অ্যালাউইটসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ইসলামপন্থি কিছু গ্রুপ। আবার ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা আসাদ সরকারকে সমর্থন দেয়।
প্রতিবেশী ইরাকে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের উত্থান হয়ে গেছে। তারা সিরিয়ারও কিছু জায়গা দখল করে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর রাক্কাকে রাজধানী ঘোষণা করে।
২০১৩ সালে দামেস্কের কাছে বিরোধী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌতায় রাসায়নিক হামলা হলে শত শত মানুষ মারা যায়। পশ্চিমারা এবং সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই হামলার জন্য আসাদ সরকারকে দায়ী করে। তবে দামেস্ক এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। পরে আন্তর্জাতিক চাপে তারা রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করতে রাজি হয়। কিন্তু তাতে করে সিরিয়া যুদ্ধের নৃশংসতা কমেনি। আরও রাসায়নিক হামলা হয়েছে পরবর্তীতে। জাতিসংঘের একটি কমিশন সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধেই হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছে।
২০১৫ সালে প্রায় পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় আসাদ সরকার। দেশের বড় অংশের ওপরই তখন বাশার আল- আসাদে আর কর্তৃত্ব ছিল না। তবে পরে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি পাল্টে যায়, গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো আবার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন বাশার আল-আসাদ।
গাজা যুদ্ধ: ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমঝোতার আলোকে সরকারি বাহিনী সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। যদিও ইসলামপন্থি বিরোধী গ্রুপগুলো এবং কুর্দি মিলিশিয়ারা দেশটির উত্তর ও উত্তরপূর্ব এলাকায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিল। ওই সমঝোতা আসাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে এবং তিনি আরব কূটনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসেন। ২০২৩ সালে আরব লীগের সদস্য পদ ফিরে পায় সিরিয়া। বেশ কিছু আরব দেশ আবার দামেস্কে দূতাবাস চালু করে।
নিজের শাসনের তৃতীয় দশকে দেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল যে প্রেসিডেন্ট তার বড় চ্যালেঞ্জগুলো উতরে গেছেন। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরাইলে হামলা করলে গাজা যুদ্ধের সূচনা হয় যা লেবাননেও ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে আসাদের সহযোগী হিজবুল্লাহর ওপর। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহও নিহত হন।
লেবাননে যেদিন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় সেদিনই বিস্ময়করভাবে হামলা করে দ্রুত আলেপ্পো দখল করে নেয় হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএসের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী। তারা দ্রুতগতিতে এগিয়ে হামা ও অন্য শহরগুলো দখল করে নেয়। দক্ষিণাঞ্চলে তখনও সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল।
কিন্তু আসাদের অবস্থান দ্রুতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে, কারণ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ইরান ও রাশিয়া তার সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা দামেস্ক ঢুকে পড়েছে এবং বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত বিমানে করে অজানা গন্তব্যে চলে গেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর মাধ্যমেই অবসান হলো সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসন।