যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আসছে বছরের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নিয়ে তার প্রথম কাজ হবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ‘আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউট’-এর অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন তিনি। প্রশাসনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রকে বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প। কোভিডের সময় টিকাবিরোধী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন কেনেডি জুনিয়র। কেবল তিনিই নন, ট্রাম্প প্রশাসনের আরও কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি : ‘আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউট’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজেরই সংস্থা। ২০২১ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ওই সংস্থাটি। এই প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একাধিক রক্ষণশীল নীতির প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। নির্বাচনের পর সেখানেই প্রথম জনসম্মুখে কথা বললেন ট্রাম্প। তিনি বারবার বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অবিলম্বে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। যদিও কীভাবে কী করবেন, সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
ট্রাম্প তার সমর্থকদের আরও বলেন, তার অন্যান্য অগ্রাধিকার হবে মধ্যপ্রাচ্য এবং ‘দুর্নীতিগ্রস্ত, ভঙ্গুর, ব্যর্থ প্রশাসনকে সাফ করা’। তবে এই পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কেও তিনি বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন।
অনুষ্ঠানটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের (নির্বাচিত প্রার্থীর) বাসভবনে হয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা যে এভাবে জিতে যাব, তা কেউ জানত না। এটি একটি বড় বিজয় ছিল।’ জনতার মাঝে থাকা অনেককে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি। তাদের মাঝে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হ্যাভিয়ের মিলেই এবং হাউস স্পিকার মাইক জনসনও ছিলেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প টেসলার মালিক ইলন মাস্কের কথাও বারবার উল্লেখ করেছেন। ইলন মাস্ক গত কিছুদিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার বাসভবনে ছিলেন। ‘তিনি এই জায়গাটি পছন্দ করেন। আমি তাকে চলে যেতে বলতে পারি না। আমিও এখানে তাকে পেয়ে আনন্দিত,’ ইলন মাস্ককে মজা করে বলছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আরও কিছু হাই-প্রোফাইল সমর্থককেও ধন্যবাদ জানান ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিবেক রামাস্বামী ও মার্কিন রাজনীতিবিদ তুলসি গ্যাবার্ড। তাদের দুজনকেই সিনিয়র পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
‘টিকাবিরোধী’ কেনেডি নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী :সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা বরার্ট কেনেডি জুনিয়র ট্রাম্প প্রশাসনে স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (এইচএইচএস) প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। কেনেডি জুনিয়রের মনোনয়ন সিনেটে অনুমোদন পেলে তিনি খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে চিকিৎসা গবেষণা এবং কল্যাণ কর্মসূচির মতো দায়িত্ব পাবেন। বর্তমানে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণে আছে সিনেট।
সাবেক স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কেনেডি জুনিয়র যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন তা আগেই জল্পনা করছিলেন মিত্ররা। আর সেটি আঁচ করতে পেরেছিলেন ট্রাম্পের কথাতেই। ভোটের বিজয় উদযাপন অনুষ্ঠানে সমর্থকদের উদ্দেশে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘কেনেডি আমেরিকাকে আবার সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করতে চান।’ তার নিয়োগ নিশ্চিতের পর এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, কেনেডি জুনিয়রের নাম মনোনয়ন করতে পেরে তিনি খুবই পুলকিত।
রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র পরিবেশ আইনজীবী, টিকাবিরোধী আন্দোলনকারী এবং ১৯৬০-এর দশকে নিহত দুই প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট নেতার ছেলে ও ভাতিজা। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছিলেন তিনি। তবে বাইডেনের পুনঃভোটের প্রশ্নে তার পরিবারের বেশিরভাগই সমর্থন করেন এবং তারা কেনেডি জুনিয়রের টিকাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
এরপরে কেনেডি জুনিয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার দিকে মনোযোগ দেন, তবে নানা বিতর্কের মধ্যে ভোটের দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের আগে শেষ দুই মাসে তিনি ‘মেইক আমেরিকা হেলদি এগেইন’ নামে ট্রাম্পের একটি প্রচার উদ্যোগে নেতৃত্বও দিয়েছেন।
কেনেডি শিশুদের টিকা দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, টিকা দেওয়ার কারণেই শিশুদের অটিজম হয়।’ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, টিকার সঙ্গে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের (এএসডি) কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রশাসন নিয়ে বিতর্ক : কেবল কেনেডি জুনিয়র নন, বিভিন্ন শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ট্রাম্প আরও যাদের বেছে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেতে যাওয়া টেলিভিশন সংবাদ উপস্থাপক পিট হেগসেথকে নিয়ে ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে।
রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। আগামী জানুয়ারি মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। তার আগে নিজ প্রশাসনে কাকে কাকে নিয়োগ দেবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। শুরুর দিকে ট্রাম্প তার প্রশাসনের জন্য ফ্লোরিডা সিনেটর মার্কো রুবিওসহ যাদের নাম ঘোষণা করেছেন, সেগুলো প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তবে রয়টার্স জানিয়েছে, পরের দিকে ট্রাম্প ঘোষিত নামগুলো নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের পাশাপাশি রিপাবলিকানদের কেউ কেউও হতাশা প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প পরের দিকে দক্ষতা বা যোগ্যতার চেয়ে কে কত অনুগত, তাকে নিয়োগ দেওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় হতাশা দেখা দিয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ম্যাট গেটজের নাম ঘোষণা নিয়ে। কট্টর এই রিপাবলিকান নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আছে। নারী পাচারের অভিযোগে কয়েক বছর ধরে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলেছে। গেটজ অবশ্য নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। এখনও তদন্ত চলছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেতে যাওয়া হেগসেথকে নিয়ে হতাশার কারণ হলো, তার বড় প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো অভিজ্ঞতা নেই। তিনি ফক্স নিউজ নেটওয়ার্কের সঞ্চালক।
রয়টার্সের ভাষ্য, ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা চাইছেন এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের প্রথম মেয়াদে যেসব কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা তার জনতুষ্টিবাদী ডানপন্থি এজেন্ডাকে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন, তাদের এ মেয়াদে আর দায়িত্বে রাখবেন না।
নিয়োগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে গেটজ অপরাধের তদন্ত থেকে মুক্তি পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। বিচার বিভাগের শীর্ষে গেটজের মতো নিজস্ব লোক বসানোর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পও সুবিধা নিতে পারেন। ট্রাম্প বারবারই বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
আসন্ন সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও গেটজকে নিয়ে ব্যাপক বিরোধিতা থাকবে। অর্থাৎ সিনেটে তার নিয়োগ চূড়ান্ত করার কাজটি অতটা সহজ হয়তো হবে না।
রয়টার্স বলছে, কেনেডিকে নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিরোধিতা হতে পারে। জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাওয়া তুলসী গ্যাবার্ডের মনোনয়ন নিয়েও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। গ্যাবার্ড বলেছেন, ‘নিরাপত্তাজনিত বৈধ উদ্বেগ’ থেকে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। তার বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ রাশিয়ার পক্ষে যাওয়া সমালোচনা হচ্ছে।
ট্রাম্প আরও ঘোষণা দিয়েছেন, তার ব্যক্তিগত আইনজীবী টড ব্লেঞ্চ এবং অ্যামিল বোভ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করবেন। পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে চুপ রাখতে ঘুষ দেওয়ার মামলায় চলতি বছর বিচার চলাকালে ট্রাম্পের পক্ষে লড়েছেন ওই দুই আইনজীবী।