দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরনের নাম রাখা হয়েছে ‘ওমিক্রন’। বলা হচ্ছে, করোনার ডেল্টা ধরনের চেয়েও এটি ভয়ংকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) জানায়, এ ধরনটি উদ্বেগজনক। তবে সংস্থাটি বলছে, মানুষের শরীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এদিকে ওমিক্রনের কারণে কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করেছে। যেসব দেশ এখনও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, তারা দেশটি থেকে আসা যাত্রীদের কঠোর কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা বলছে, এর মাধ্যমে তাদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়েছে। একের পর এক দেশের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাকে ‘অন্যায্য’ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খবর দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি ও এএফপিসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের।
জানা গেছে, ২৪ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রনের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে। এরপর বতসোয়ানা, বেলজিয়াম, হংকং ও ইসরাইলে এ ধরনের খোঁজ পাওয়া যায়। শনিবার সর্বশেষ জার্মানিতে করোনার নতুন এ ধরনে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুক্রবার এক বিবৃতিতে করোনার নতুন ধরনটির নাম ‘ওমিক্রন’ রাখার কথা জানায়। এর আগে প্রাথমিকভাবে এটির নাম দেওয়া হয়েছিল বি.১.১.৫২৯। এদিন এক জরুরি বৈঠকের পর এ বিবৃতি দেয় সংস্থাটি। এতে আরও বলা হয়, ওমিক্রন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। ধরনটির সংক্রমণের ক্ষমতা এবং শারীরিক জটিলতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন এনেছে কিনা তা এ সময়ের মধ্যে খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি করোনার প্রচলিত চিকিৎসা ও টিকার ওপর কোনো প্রভাব আসবে কিনা তা জানার চেষ্টা করবে বিজ্ঞানীরা।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে তুলনামূলক দুর্বল আলফা, বেটা ও গামা ধরনও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। তাই ওমিক্রন শনাক্তের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নতুন করে ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি দেশ থেকে ফ্লাইট চলাচলের ওপর জরুরিভিত্তিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জোটের নির্বাহী বিভাগ ইউরোপীয়ান কমিশন ওমিক্রনের ঝুঁকি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু না জানা পর্যন্ত অঞ্চলটির দেশগুলোর সঙ্গে স্থায়ী ফ্লাইট নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছে। এরপরই একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি আরব দেশ। আফ্রিকার ছয়টি দেশ থেকে বিমান চলাচলে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্যও।
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ আফ্রিকা ও এর আশপাশের সাতটি দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশগুলো হলো-দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, লেসেঙ্গো, এসয়াতিনি, মোজাম্বিক ও মালাওয়ি। শনিবার অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, ইরান, ব্রাজিল, কানাডা ও থাইল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকা ও এর আশপাশের কয়েকটি দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। দেশে পর্যটকদের কড়া নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে ভারত। সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোকে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজেশ ভূষণ। বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জো ফালা। কিছু নেতা ‘বলির পাঁঠা’ খুঁজছিল বলে অভিযোগও তোলেন তিনি। তবে জো ফালা কারও নাম নেননি। নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া একেবারে অযৌক্তিক। জো ফালা বলেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ভুল পদক্ষেপ। এ নিষেধাজ্ঞা মানুষকে ভুল ইঙ্গিত দেবে এবং তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি ও মানদণ্ডের পরিপন্থি। আমাদের মনে হচ্ছে, কিছু দেশের নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য কোনো বলির পাঁঠা খুঁজছিলেন।
ওমিক্রন সম্পর্কে যা জানা গেছে : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এ ধরনটি অনেক রূপ বদলে এ অবস্থায় এসেছে। এ ধরনটির স্পাইক প্রোটিনে ৩০টির বেশি মিউটেশন রয়েছে। অতি সংক্রামক ডেল্টার তুলনায় সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের দেহকোষে ঢুকে পড়ার জন্য ভাইরাস মূলত এটাকে ব্যবহার করে থাকে। এমন নাটকীয় পরিবর্তনের কারণে এ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে এর আগে সংক্রমিত হওয়ার কারণে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি অথবা করোনার টিকা ধরনটির সঙ্গে আর মানিয়ে নিতে পারবে না।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের সংক্রামক রোগ বিষয়ক সংস্থা ইমপেরিয়াল ডিপার্টমেন্ট অব ইনফেকশাস ডিজিজের একজন ভাইরোলজিস্ট নতুন এ ধরনকে ‘ভয়াবহ’ ও ‘এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধরন’ বলে বর্ণনা করেছেন। শুক্রবার পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা ও হংকংয়ে ৫৯ জন ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধরনটির অস্বাভাবিকভাবে জিনগত রূপ বদলের ব্যাপারটি থেকেই বোঝা যায় যে এটি সম্ভবত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে এসেছে।