মোঃ মামুন হোসেন : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু একটি ঘটনার বিবরণ নয়, বরং এটি ছিল জনতার সুদীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ, যা একাধারে রাজনৈতিক দুঃশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অনৈক্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবেও বিবেচিত। এই অভ্যুত্থান শুধুই একটি তারিখ বা আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ও বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার একটি রূপান্তরময় মুহূর্ত। জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, শাসকদের গণবিচ্ছিন্নতা, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব। জনগণ যখন বারবার আশাহত হয়েছে, তখন তারা রাজপথে নেমে এসেছে নিজেদের অধিকারের দাবিতে। শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ জনগণ একাত্ম হয়ে একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের জন্ম দেয়, যা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ, যাদের কাঁধে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়, তারাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ব্যর্থ রাজনীতি, বেকারত্ব, জীবনমানের অবনতি ও গণতন্ত্রহীনতা তরুণদের হতাশ করে তোলে। তারা সামাজিক মাধ্যমে, মিছিলে, সভা-সমাবেশে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। এসব ক্ষোভ একসময় বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে জুলাই মাসের সেই অভ্যুত্থানে।
এই অভ্যুত্থান ছিল মূলত এক মুক্তির আহ্বান—একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল: ন্যায়বিচার: দেশে বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট অবস্থান। সুশাসন: প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। অর্থনৈতিক সমতা: ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য জীবনমান নিশ্চিত করা। মৌলিক অধিকার: বাক-স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার। জনগণ চেয়েছিল একটি বাংলাদেশ যেখানে মানুষ ভয়হীনভাবে নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে, মতপ্রকাশ করতে পারবে, এবং প্রতিটি মানুষ রাষ্ট্রের কাছে সমান মর্যাদা পাবে। তবে বাস্তবতা সবসময় আশাবাদের মতো সহজ ছিল না। শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই এই গণ-আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, নানা দমন-পীড়ন চালানো হয়। গ্রেফতার, গুম, মামলা এবং প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকে দুর্বল করতে চায় তারা। অনেক সময় সাধারণ মানুষ এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন—আন্দোলনের নেতৃত্ব, দিকনির্দেশনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে। এতে আন্দোলনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়, বিভ্রান্তি তৈরি হয়, এবং শাসকগোষ্ঠী সুযোগ নেয় আবারও নিজেদের অবস্থান শক্ত করার। তবে গণআন্দোলন কখনোই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় না। এটি মানুষের চেতনায় পরিবর্তনের বীজ বপন করে। জনগণ উপলব্ধি করে তাদের সম্মিলিত কণ্ঠ কতটা শক্তিশালী হতে পারে। আন্দোলনচাপেই হয়তো পরে অনেক রাজনৈতিক সংস্কার, নীতিমালা ও সচেতনতা গড়ে ওঠে। জুলাই অভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক জগতে নয়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনে। মানুষ বুঝতে শেখে—একটি দেশের শাসনব্যবস্থা কেবল রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না, জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব নয়। তরুণ প্রজন্ম নতুনভাবে চিন্তা করতে শুরু করে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা শুরু হয়। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কার, স্বচ্ছতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও এগুলো অনেক সময় লোকদেখানো পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থেকেছে, তবুও গণচাপের কারণে কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—জনগণের আকাঙ্ক্ষা যদি বাস্তবতার মুখে প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হয়, তাহলে একসময় সেটি বিস্ফোরিত হবেই। এই অভ্যুত্থান ছিল সেই দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা হতাশার বিস্ফোরণ, যা আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণ। আমরা যদি এই অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিই, তাহলে আগামীদিনে একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। অন্যথায় ইতিহাস আমাদেরকে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখাবে।এই জন্য আমাদের প্রয়োজন জনগণের কণ্ঠকে সম্মান করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, আর একটি সক্রিয়, দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজ গড়ে তোলা। তাহলেই “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান” শুধুই একটি স্মৃতি নয়, বরং একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।