এক বছর ধরে চলা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলি নৃশংসতায় গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে মৃতের ভাগাড়ে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, বাতাসে ভাসছে পচা-গলা মরদেহের গন্ধ। পুরো গাজাজুড়ে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মৃত্যুর গন্ধ পৌঁছায়নি। লাশ দাফনের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত কফিনও। এমন কোনো স্থান বাকি নেই যেখানে দখলদার বাহিনী হামলা চালায়নি। উপত্যকাটির স্কুল, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, মসজিদ সবকিছুই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) প্রধান ফিলিপ লাজারিনি গাজার এ পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। বলেছেন, সব জায়গায় লাশের গন্ধ। রাস্তায় অথবা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছে মরদেহ। এসব মরদেহ সরাতে অথবা মানবিক সহায়তার কার্যক্রমও পরিচালনা করতে দেওয়া হচ্ছে না। আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের সহায়তার জন্য উত্তর গাজায় জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের অনুরোধ জানিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লাজারিনি বলেন, ইউএনআরডব্লিউএ-এর কর্মীরা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না। কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও দ্রুত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার আহ্বান জানান তিনি। বিশেষ করে আশ্রয় প্রার্থীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন তিনি।
এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের যুদ্ধের ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো উন্নয়ন সূচকগুলো প্রায় ৭০ বছর পিছিয়ে গেছে। এর ফলে আরও কয়েক মিলিয়ন ফিলিস্তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। জাতিসংঘের একটি নতুন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরাইলের আক্রমণের শুরু থেকে ফিলিস্তিনি অর্থনীতি এখন ৩৫ শতাংশ ছোট হয়ে গেছে। বেকারত্বের হার ‘সম্ভাব্যভাবে বেড়ে’ ৪৯.৯ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, গাজার ‘মানব উন্নয়নের প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে গড় অর্জন’ নির্দেশকারী মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) ১৯৫৫ সালের স্তরে নেমে আসতে পারে। এতে ৬৯ বছরের অগ্রগতি মুছে যাবে। অন্যদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে এইচডিআই এমন স্তরে নেমে আসতে পারে, যা ১৬ বছরের ক্ষতি নির্দেশ করবে।
ইসরাইলি সামরিক হামলা বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বছর গাজার দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৭৪.৩ শতাংশে পৌঁছবে। সামগ্রিকভাবে গাজা উপত্যকা, অধিকৃত পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এখন ৪১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে, যাদের মধ্যে গত বছরই ২৬ লাখ ১০ হাজার মানুষ যোগ হয়েছে।
গাজার কেন্দ্রস্থল দেইর আল বালা থেকে ইউএনডিপি প্রতিনিধি চিতোস নোগুচি বলেন, ফিলিস্তিনের অবস্থা অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ইউএনডিপির প্রধান আচিম স্টেইনার জানিয়েছেন, অবকাঠামোগত ধ্বংস, দারিদ্র্য ও জীবিকা হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রভাব ‘বিপুল’। তিনি আরও বলেন, এই সামাজিক-অর্থনৈতিক মূল্যায়ন থেকে এটা স্পষ্ট, ধ্বংসের স্তর ফিলিস্তিনকে উন্নয়নের পথকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিয়েছে, সম্ভবত কয়েক দশকও। তিনি সতর্ক করেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রতি বছর মানবিক সহায়তা প্রদান করলেও ফিলিস্তিনি অর্থনীতি সংকট আগের অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তত এক দশক লাগবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরাইলের বোমা হামলা গাজায় ৪২ মিলিয়ন টন ধ্বংসস্তূপ তৈরি করেছে, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, সোলার প্যানেল ধ্বংস হওয়ায় সেগুলো থেকে সিসা ও অন্যান্য ভারী ধাতু বেরিয়ে আসছে, যা বিপজ্জনক।
মূলত গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসন থামার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। অবরুদ্ধ এই উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে গত ৪৮ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ১১৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরও ৪৮৭ জন। স্থানীয় চিকিৎসা সূত্র বলছে, মঙ্গলবার গাজাজুড়ে ইসরাইলি হামলায় আরও ৪০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে যাদের বেশিরভাগই গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা। ১৮তম দিনের মতো উত্তরাঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলি বাহিনী ‘আড়াই লাখেরও বেশি সহায়তা ও পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রবেশে বাধা দিয়েছে’। এতে ৯৬ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৪২ হাজার ৭১৮ জন নিহত এবং এক লাখ ২৮২ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে।