সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন

কনডেম সেল থেকে ফোন করে ভাই-ভাতিজার জন্য ভোট চাচ্ছেন সেই নূর হোসেন

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২২, ৩.৫১ এএম
  • ৪০৩ বার পড়া হয়েছে

‘দিন রাত এখানেই থমকে গেছে/কনডেম সেলের পাথর দেয়ালে/প্রতি নিঃশ্বাসে মৃত্যুর দিন আমি গুনছি/শোনো, জেল থেকে আমি বলছি…’। এখনও কানে বাজে নব্বই দশকের জেমসের জনপ্রিয় গানটি। সেই গানের কলিটাই এবার বাস্তবে ফিরেছে। নারায়ণগঞ্জের ‘সাত খুন’ ঘটনা নিশ্চয় মনে আছে সবার। ‘সাত খুন’ আলোচনায় এলে পুরোভাগে চলে আসে আরেকটি নাম। তিনি নূর হোসেন। ফাঁসির দণ্ড নিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের কনডেম সেলে। তবে এতটুকুও কমেনি তার ক্ষমতার তেজ আর হুঙ্কার।

 

‘হ্যালো, জেল থেকে আমি নূর হোসেন বলছি।’ ফোনে নূর হোসেনের নাম শুনে প্রথমে ভড়কে যান মুরুব্বি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। আসলেই কি নূর হোসেন? নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! মুরুব্বি মনে মনে ভাবছিলেন, তার তো এখন কারাগারের কনডেম সেলে থাকার কথা, তাহলে কোথা থেকে ফোনে কথা বলছেন। নিজেকে সামলে, ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা কণ্ঠটি নূর হোসেনের নিশ্চিত হয়েই মনোযোগী শ্রোতা বনে যান তিনি। নূর হোসেন হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘শোনেন, আপনারা আমার ভাই নূর উদ্দিনকে পাস করান। টাকা-পয়সা যা লাগে নেন, কিন্তু নূর উদ্দিনকে পাস করান। যদি না করান তাইলে আমি ২০২৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাইতাছি। তখন কিন্তু কাউরে ছাড়ূম না। যা করার করমু।’

 

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের দুটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভাই-ভাতিজাকে জেতাতে কারাগারের কনডেম সেলে বসেই মোবাইল ফোনে বয়োজ্যেষ্ঠদের এভাবেই তালিম দিয়ে যাচ্ছেন এই কয়েদি। আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নাসিক নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন নূর হোসেনের ছোট ভাই নূর উদ্দিন আর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভাতিজা শাহ জালাল বাদল। দু’জনার প্রতীকই ঠেলাগাড়ি। ভোটের মাঠে তাদের দু’জনের পক্ষে নামতেই এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের খুঁজে খুঁজে বের করে এমন বাক্যবাণে ভীতি ছড়াচ্ছেন।

 

২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নূর হোসেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে প্যানেল মেয়র পদের লড়াইয়ে এক ভোটের ব্যবধানে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর হাজি ওবায়েদ উল্লাহর কাছে হারেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে নাসিকের প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল বিকেলে লাশ ভেসে উঠলে নূর হোসেন গা-ঢাকা দেন। ওই বছরের মে মাসে তিনি ভারতে পালান। পরে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সাত খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকায় নূর হোসেনকে কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্তও করা হয়।

 

নূর হোসেন সাত খুন মামলার ফাঁসির দণ্ড পাওয়া প্রধান আসামি। তাকে বর্তমানে রাখা হয়েছে কারাগারের কনডেম সেলে। সাত খুন ছাড়াও নূর হোসেনের নামে বিভিন্ন অভিযোগে আরও ছয়টি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে নারায়ণগঞ্জ আদালতে।

 

এদিকে জেলে বসেই নিজের সম্রাজ্য ঠিকই অটুট রেখেছেন নূর হোসেন। এলাকার অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন বয়োজ্যেষ্ঠদের ইতোমধ্যে জেল থেকে ফোন দিয়ে ভাই ও ভাতিজার পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। কারাগার থেকে তার মতো একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসীর ফোন পেয়ে এলাকার মুরুব্বিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী করবেন, সেটাও বুঝে উঠতে পারছেন না।

 

কারাগারে বসে নূর হোসেন যাদের ফোন দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। প্রথমে তারা স্বীকার না করলেও পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হন। তারা জানান, নূর হোসেন তার ছোট ভাই নূর উদ্দিন ও ভাতিজা শাহজালাল বাদলের পক্ষে ভোটের মাঠে নামতে নির্দেশ দিয়েছেন। না নামলে এবং তার ভাই ও ভাতিজা পাস না করলে ২০২৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে তাদের কাছে নূর হোসেনের ফোনগুলো এসেছে। নূর হোসেনের কণ্ঠ শুনেই ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে যেত বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।

 

এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের অনেকেই জানতে চেয়েছেন এটা কীভাবে সম্ভব? ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামি যিনি কনডেম সেলে আছেন, তিনি কীভাবে জেলে বসে ফোন করেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের একজনের কাছ থেকে নূর হোসেনের সেই কারাগারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন এই প্রতিবেদক। পরে গত মঙ্গলবার রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে সেই নম্বরে ফোন করতেই অন্য প্রান্তে সেটি রিসিভ করেন স্বয়ং নূর হোসেন। কণ্ঠ চিনতে পেরে এই প্রতিবেদক কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে কথা চালিয়ে যান। এক সময় নিশ্চিত হন নূর হোসেনই ফোনের অন্য প্রান্তে কথা বলছেন।

 

এই প্রতিবেদক নূর হোসেনকে জানান, নির্বাচনে তার ভাইয়ের অবস্থান ভালো। তখন নূর হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটের ফল পাওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া যায় না।’ তখন এই প্রতিবেদক বলেন, ‘আপনি ফোন দেওয়ার পর মাঠের চিত্র পাল্টে গেছে।’ তখন নূর হোসেন পরিচয় জানতে চাইলে এ প্রতিবেদক বলেন, ‘আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। নাম নাই বা জানলেন।’ নূর হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সেই ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ডিং এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

 

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় ভাইয়ের মধ্যে নূর হোসেন চতুর্থ এবং নূর উদ্দিন পঞ্চম। ভাতিজা বাদল ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনেও কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাত খুনের পর চাচাদের সঙ্গে এলাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়ার পর এবং অভিযোগপত্রে তার নাম না থাকায় তিনি ২০১৫ সালে এলাকায় ফিরে আসেন।

 

ভাতিজা শাহ জালাল বাদল ও চাচা নূর উদ্দিন উভয়েই একাধিক মামলার আসামি। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া উভয়ের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসএসসি পাস শাহ জালাল বাদলের নামে বিভিন্ন অভিযোগে ৪টি মামলা বিচারাধীন। আরও ৮টি মামলা থেকে খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছেন। আর স্বশিক্ষিত নূর উদ্দিনের নামে বিভিন্ন অভিযোগে ৭টি মামলা বিচারাধীন। দুটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।

৩ নম্বর ওয়ার্ডে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদল তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীদেরও হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১ ডিসেম্বর রাতে বাদলের অনুসারীরা দুই প্রার্থীর কর্মীদের মারধরও করেন।

 

এ ব্যাপারে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে নূর উদ্দিন বলেন, ‘ভাই আমার ফিল্ড খুবই ভালো। এলাকায় আমার জোয়ার দেখে প্রতিপক্ষরা গুজব ছড়াচ্ছে। এগুলো সত্য নয়।’ অন্যদিকে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদল বলেন, ‘নির্বাচন তো, সবই হচ্ছে রাজনীতি।’

 

গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে থেকে কীভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া নূর হোসেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার এমএ জলিল বলেন, ‘জেল কোড অনুযায়ী একজন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কয়েদি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তার সবই পান। সপ্তাহে একদিন টেলিফোনে ১০ মিনিট করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। এ সুযোগ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।’ কিন্তু নূর হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে জানালে জেল সুপার বলেন, ‘এটা সম্ভব নয়। তিনি অবৈধ পন্থায় এটি করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখব। কোনো অনিয়ম প্রমাণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

আইভীও তাদের সঙ্গে : এদিকে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকেও নূর হোসেনের ভাই-ভাতিজার পাশে দেখে আরও ভড়কে যান জেল থেকে নূর হোসেনের ফোন পাওয়া এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরা। কারণ আইভীকে তারা সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবেই চেনেন। কিন্তু গত ১ জানুয়ারি ৩ নম্বর ওয়ার্ডে এক পথসভায় আইভীর পাশে শাহ জালাল বাদলকে দেখা যায়। তার পরদিন ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগে গেলে আইভীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন নূর উদ্দিন ও তার সহযোগীরা।

 

এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে আইভীর ঘনিষ্ঠ ও তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দীপু বলেন, শাহজালাল বাদল যাই হোক না কেন, তিনি ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দু’বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। ২০১৬ সালে ৭ খুনের ঘটনার কারণে বাদলকে আইভীর প্রচারণায় ঘেঁষতেই দেওয়া হয়নি। তারপরও ওই বছর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বাদল পাশ করেন। এবারও তিনি প্রার্থী। তাই আইভী তার সঙ্গে পথসভায় অংশ নিয়েছেন। আর ৪ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলরসহ অন্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজে থেকেই তার গণসংযোগে এসেছেন। কাউকে তিনি ডেকে আনেননি। নিষেধও করেননি।তথ্যসূত্র-সমকাল

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort