রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ অপরাহ্ন

ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণহীন

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪, ৯.৫৬ এএম
  • ১ বার পড়া হয়েছে

আবারও বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম। গত কয়েক দিনের মধ্যে তীব্র ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিকস, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও ইনজেকশনসহ কোনো কোনো কোম্পানির ওষুধ এক পাতার দাম ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে।

অর্থাৎ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর নিত্যপণ্যের দামের মতো লাগামহীনভাবে দাম বাড়ার ফলে জিম্মি হয়ে পড়ছেন রোগীরা। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

তাদের অভিযোগ, এমনিতেই যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের জেরে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত একেকজন রোগীর প্রতি মাসে ওষুধ খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে অনেক সময় কাঁটছাট করে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ওষুধ যেহেতু অতি জরুরি বিষয়, তাই ভোক্তারা ওষুধের দাম নিয়ে দরকষাকষির সময় ও সুযোগ কোনোটিই পান না। সেখানে নতুন করে দাম বৃদ্ধি কতটা যুক্তিযুক্ত?

পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, দাম বাড়ার কারণে ওষুধ বিক্রেতাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের চিকিৎসাবাবদ মোট খরচের বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। এতে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে দর বাড়ায় বিপাকে পড়বে সাধারণ মানুষ। এর সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। আর ওষুধের মূল্য নিয়ে বাজারে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য চলছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা অর্জন ও দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ তাদের।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে সরকার। অথচ দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনসিয়াল ড্রাগসের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) জন্য ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির যুক্তি, বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে ওষুধের দাম বাড়ছে। গত ২৯ এপ্রিল দেশে ওষুধের দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে বেশ কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি সময়ের আলোকে জানান, ওষুধের দাম আরও বাড়বে। তারা তাদের কোম্পানির তরফ থেকে ইতিমধ্যে এমন বার্তা পেয়েছেন।

শুক্রবার রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, নাজিরাবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা এবং শাহবাগের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসি ঘুরে ওষুধের দাম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত পনের দিন আগে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় ব্যবহার করা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি কোম্পানির ট্যাবলেট টেরাক্স-১০ প্রতি পিস বিক্রি হতো ১২ টাকায় আর এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একই কোম্পানির উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যামলোসার্ট ট্যাবলেট এক পাতা ১০টির দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে একই কোম্পানির ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের কমেট-মেটফরমিন হাইড্রোক্লোরাইড এক পাতা ১০টির দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়াও স্কয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-৩ ডিএস ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের দাম প্রতিটি ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রসুভা (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। দুটিরই মূল্য বেড়েছে ২০ শতাংশ।

রোগীদের ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যায় এসিআই লিমিটেড কোম্পানির ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ টাকা বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। মূল্য বেড়েছে ২৫ শতাংশ। একই কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুক্লক্স ৫০০ মিলিগ্রাম ভায়ালের দাম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যান্টিবায়োটিকের ট্যাবলেট রোজিথ ৫০০ মিলিগ্রামের প্রতি পিসের দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত উইন্ডেল গ্লাস রেস্পিরেটর সল্যুশনের পাঁচ এমএলের বোতলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিজ (বিডি) লিমিটেড হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলি কুইকপেন ৫টির এক প্যাকের দাম ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বাইজোরান ৫/২০ ট্যাবলেট কয়েক দিন আগেও এক পাতার ১৫টির দাম ছিল ১৫০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। বেড়েছে ২০ শতাংশ।

এ ব্যাপারে শাহবাগের পপুলার মেডিসিন সেন্টারের দোকানি সঞ্জয় কুমার সময়ের আলোকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও কম-বেশি কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। ফার্মেসির হতদরিদ্র মানুষের কথা বাদ দিলেও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে আমরাও অনেক সময় ঝামেলায় পড়ি।

শাহবাগ বিপণি বিতান মার্কেটের নাজ ফার্মার দোকানি কমল সরকার সময়ের আলোকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক, ভিটামিনসহ অনেক ওষুধেরই দাম বেড়েছে। কোনটা রেখে কোনটার নাম বলব। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ওষুধের দাম বাড়ছে।

পরিবাগে মডিউল জেনারেল হাসপাতাল ফার্মেসির কর্মচারী নিশি রায় সময়ের আলোকে বলেন, আমরা শুনেছি কয়েক দিনের মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম বাড়বে। কিন্তু এখানে আমাদের তো কিছুই করার নেই।

ওষুধের দাম বৃদ্ধি মানে সাধারণ মানুষের ওষুধ সেবনে বাধা উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, শুধু ওষুধ নয়, সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই দাম কতটা যৌক্তিকভাবে বেড়েছে সেটিই প্রশ্ন। কারণ ওষুধ হচ্ছে কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। ওষুধ তো চাল-ডালের মতো নয় যে, বেশি দামেরটা না কিনে কম দামেরটা কিনে খাওয়া যায় বা অল্প পরিমাণে খেয়ে থাকা যায়।
চিকিৎসক যেভাবে রোগীকে প্রেসক্রিপশন করবে সেভাবেই খেতে হবে, নইলে অসুখ তো সারবে না বরং আরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। ফলে দাম বাড়ার কারণে দরিদ্র ও অসচ্ছল মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাদের হয় ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে নতুবা কোনোভাবে পরিবারের লোকজনকে স্যাক্রিফাইস করতে হবে। আর ওষুধ কিনতে গিয়ে যদি না খেয়ে থাকতে হয় তা হলে পুরো পরিবারের ওপর প্রভাব পড়বে। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি দেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হয়েছে, যার বেশিরভাগই খরচ হচ্ছে ওষুধ কেনার পেছনে।

এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বলেন, কোনো কোম্পানি ইচ্ছে করলেই ওষুধের দাম বাড়াতে পারে না। বাড়াতে হলে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটি শুধু অধিদফতরের কাজ নয়। তবে সম্প্রতি কিছু ওষুধের দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমরা একই শ্রেণির ওষুধ বাজারে প্রচলিত যা রয়েছে তার চেয়ে বেশি দাম বৃদ্ধির অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। শুধু দামটা সমন্বয় করা হয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2021 rudrabarta24.net
Theme Developed BY ThemesBazar.Com

sakarya bayan escort escort adapazarı Eskişehir escort